শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

মেডিটেশন চর্চায় শারীরিক সুস্থতা

ডা. আয়েশা হান্না

মেডিটেশন চর্চায় শারীরিক সুস্থতা

নিজের যত্নায়ন, দেহ-মনের দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলোর স্বাভাবিক গতি বহাল রাখা কিংবা রোগ নিরাময়-সব ক্ষেত্রেই মেডিটেশন চর্চার রয়েছে দারুণ প্রভাব। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ওষুধের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো মেডিটেশন চর্চার ফলেও দেহে সৃষ্ট ইতিবাচক স্পন্দন রোগ নিরাময়ে একই রকম পরিবর্তন আনে। গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, রোগ নিরাময়ে ওষুধের সার্থক বিকল্প হতে পারে মেডিটেশন। আজ ২১ মে পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। চলুন জানি, শরীরের কয়েকটি অঙ্গের ওপর মেডিটেশনের ইতিবাচক কিছু প্রভাব সম্পর্কে।

ব্রেন : মস্তিষ্কের কর্পাস কলোসামের পুরুত্ব বাড়ায় মেডিটেশন। কর্পাস কলোসাম ব্রেনের ডান ও বাম বলয়ের সমন্বয় সাধন করে। মটর ও সেনসরি নিউরোনের কাজের ওপর এই অংশের প্রভাব ব্যাপক। ধ্যান মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোবকে শান্ত রাখে। ফলে একাকিত্ববোধ ও নেতিবাচক আবেগ দূর হয়। দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিজনিত কার্যক্রম পরিচালনা করে গ্রোথ হরমোন। মস্তিষ্ক থেকে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে ডেল্টা ব্রেনওয়েভ। গভীর নিদ্রা এবং ধ্যানাবস্থায় এ ব্রেনওয়েভ তৈরি হয়। মেডিটেশন চর্চা ব্রেনের গ্রে ম্যাটারকে সমৃদ্ধ করে। হিপোক্যাম্পাসকে সতেজ রাখে। ফলে স্মৃতিশক্তিজনিত রোগ দূর হয়।

কিডনি : ভারতে ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত ১৭৫ রোগীর ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয় ২০২১ সালে। ১২, ১৭ ও ২১ মাসের নিয়মিত মেডিটেশন ও ফলোআপের পর গবেষকরা জানান, ধ্যানচর্চার ফলে রোগীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতির কথা। কিডনির ঊর্ধ্বভাগে এড্রিনালিন গ্ল্যান্ড থেকে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল উৎপাদনের মাত্রা কমায় মেডিটেশন। ফলে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টিগ্রেটিভ কিডনি ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, শিথিলায়ন মেডিটেশনে রোগীদের চোখ বন্ধ রেখে স্নায়ুপেশি শিথিল করা, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি সচেতন হতে বলা হয়। মেডিটেশনের এই কৌশলটি উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার মাত্রা কমায় এবং ঘুমের মান উন্নত করে।

ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড : ধীরলয়ে দম নেওয়া ও ছাড়ার ফলে ফুসফুস, ধমনি ও হৃদপেশির সুস্থতাও সুনিশ্চিত হয়। রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। হৃৎপিন্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার এমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সাইকোলজিস্ট ও বিহেভিয়ারাল সায়েন্টিস্ট ডোনাল্ড নোবেল দমচর্চার ওপর দীর্ঘ গবেষণা করে বলেন, ধ্যানীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার তুলনামূলক কম থাকে। মেডিটেশনকালে ধীরলয়ে নেওয়া দম ফুসফুসকে অধিক সক্রিয় করে তোলে।

হাড় : অস্টিওপরোসিসের মতো হাড় ক্ষয়জনিত ব্যথাবেদনা দূর করতে ও হাড়ের ক্ষয়প্রাপ্ত টিস্যু মেরামত করে মেডিটেশন।

ওজন নিয়ন্ত্রণ : নিয়মিত মেডিটেশন মানসিক চাপ কমায়, রক্তে ইনসুলিন হোমিওস্ট্যাসিস পুনরুদ্ধার করে। ফলে দেহে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওজন নিয়ন্ত্রণে ইচ্ছুক ১১৬০ জনের ওপর ২০১৮ সালে ১৯টি গবেষণা পরিচালিত হয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাইন্ডফুলনেস বা মেডিটেশন অনুশীলন পরিমিত খাবার গ্রহণে সদিচ্ছা তৈরি করে।

পাকস্থলী : মেডিটেশনে গভীরভাবে দম নেওয়ার ফলে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত শরীরজুড়ে প্রবাহিত হয়, যা পরিপাকতন্ত্র বিশেষ করে পাকস্থলী ও অন্ত্রের আবরণকে সুস্থ রাখে। মেডিটেশনে শরীরের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি সরবরাহ করতে নিয়োজিত কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়। ফলে পেটের সমস্যা যেমন- এসিডিটি, আইবিএস, আইবিডি থেকে মুক্তি মেলে।

পঞ্চ ইন্দ্রিয় : পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সতেজতা ও সক্রিয়তা বাড়াতে ইন্দ্রিয়গুলোতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা তথা মেডিটেশন করার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তা মানসিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

চর্মরোগ : ধ্যান শরীরের প্রদাহ প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে। ত্বকের মসৃণতা ও কোমলতা ধরে রাখে। চর্মরোগ ও ব্রণ কমাতে সাহায্য করে। মার্কিন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও মাইন্ড-বিউটি কানেকশন বইয়ের লেখক ডা. এমি ওয়েশলার বলেন, মস্তিষ্ক এবং ত্বক একই ভ্রƒণীয় স্তর থেকে তৈরি হয় এবং এদের মধ্যে আন্তসংযোগ রয়েছে।

নারীদের হরমোন ভারসাম্য : মেডিটেশনের হরমোন ভারসাম্যের ক্ষমতার কারণে পাশ্চাত্যের নারীদের ধ্যানচর্চায় আগ্রহ বেড়েছে। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস)-এ ভুগছেন এমন রোগীকে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চার ফলে ডিম্বাশয়ে সিস্টের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

এইচআইভি : এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সিডিফোর টি-সেলকে রক্ষা করতে মেডিটেশন কার্যকর। দেহে এ রোগের অগ্রগতিকে শ্লথ করে মেডিটেশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে দেহে স্ট্রেস কমে, ফলে এইডস রোগীদের দেহে ভাইরাস ধ্বংসকারী সিডিফোর নামক শক্তিশালী কোষ বৃদ্ধি পায়।

ক্যান্সার : দেহকোষের বৃদ্ধি, কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে টেলোমেরেস নামক ক্রোমোজোমের অংশবিশেষ। মেডিটেশন টেলোমেয়ারকে সুরক্ষিত রাখে। ফলে ক্রোমোজোমগুলো সক্রিয় কোষ তৈরি করে। অনিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজনের কারণে ক্যান্সার কোষ তৈরি রহিত হয়। ক্যান্সার কোষ নির্মূলে মেডিটেশনের ভূমিকা লক্ষণীয়। ২০১৯ সালে ২৯টি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সারে আক্রান্ত যে রোগীরা মেডিটেশন করেন তাদের মানসিক যন্ত্রণা, ক্লান্তি , ব্যথা এবং বিষণ্ণতার লক্ষণ কম হয়।

কান : এড্রিনালিন হরমোনের অধিক নিঃসরণে কানের ভিতর রক্তসঞ্চালন হ্রাস পায়। ফলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। অন্যদিকে মেডিটেশন এড্রিনালিন হরমোনের নিঃসরণ কমায়। ফলে একজন ধ্যানীর শ্রবণশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শব্দ বোঝার ক্ষমতাও বাড়ে। আমেরিকান টিনিটাস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের ক্রনিকাল টিনিটাসে (কানে শব্দ বেজে ওঠা রোগ) আক্রান্ত।  শ্রবণশক্তি বাড়াতে ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মেডিটেশন চর্চার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল

সর্বশেষ খবর