শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার বন্ধু হুমায়ূন ফরীদি

ইমদাদুল হক মিলন

আমার বন্ধু হুমায়ূন ফরীদি

হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে পরিচয় হলো বাহাত্তর সালে। স্বাধীনতার পরের বছর। বছরের বোধহয় শেষদিকে। আমি তখনো লেখক হইনি, ফরীদি তখনো অভিনেতা হয়নি। আমি তখন থাকি গেন্ডারিয়াতে।

গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাসায় ভাড়া থাকি। আব্বা মারা গেলেন একাত্তর সালের অক্টোবরে। দশটা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা আছেন অতি কষ্টে। বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে নাইটে জগন্নাথে বি কম পড়ে, টঙ্গীর ওদিকে একটা চাকরি করে। আব্বা চাকরি করতেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। আব্বার জায়গায় বড় ভাইয়ের চাকরি হলো। আমি আর আমার বড় বোন একাত্তর সালে এসএসসির ক্যান্ডিডেট। যুদ্ধের জন্য পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পরপর পরীক্ষা দিলাম। বাহাত্তর সালে আমি জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। রজনী চৌধুরী রোডের সেই গলিতে, আমাদের বাসার ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটা হলো বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার হামিদ ভাইদের বাড়ি। তার দক্ষিণ দিককার বাড়ির নিচতলায় আত্মীয়ের সঙ্গে থাকে এক যুবক। জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ে। লেখে বাঁ হাতে। হাতের লেখা খুবই সুন্দর। সে একজন তরুণ কবি। নাম মাহমুদ শফিক। ওই বয়সেই তাঁর একটা কবিতার বই বেরিয়ে গেছে। বইয়ের নাম ‘ছবি প্রকাশিত হলে’। শফিকের সঙ্গে অনেক তরুণ কবির যোগাযোগ। বড় পত্রিকা থেকে শুরু করে অনেক ছোটখাটো পত্রিকারও যোগাযোগ। নারায়ণগঞ্জ থেকে তখন একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বেরুতো। পত্রিকার নাম ‘কালের পাতা’। সম্পাদক সিরাজুল হক। তিনি একজন লেখক। সিরাজুল হক সাহেবের বড় ছেলে মুজিবুল হক কবীর একজন তরুণ কবি। জগন্নাথে শফিকের সঙ্গে পড়ে। ভালো বন্ধুত্ব দুজনের। গেন্ডারিয়া থেকে প্রায়ই দুপুরের পর নারায়ণগঞ্জে রওনা দেয় শফিক। লোহারপুলের দক্ষিণ দিককার ঢাল থেকে বাসে চড়ে নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিনের অদূরে গিয়ে নামে। এ ধরনের বাসগুলোর একটা ডাকনাম ছিল। মুড়ির টিন। আসল নাম ‘টাউন সার্ভিস’। ছ আনা বা আট আনায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে ছাড়ত, ভিক্টোরিয়া পার্কের ওদিক থেকে ছাড়ত। ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম ততদিনে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ হয়ে গেছে। সেই পার্কের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে ‘মিউজিক্যাল মার্ট’ নামে একটা স্টুডিও ছিল। বিখ্যাত লোকজন গিয়ে ছবি তুলত সেই স্টুডিওতে। নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ত ওই স্টুডিওর সামনে থেকে। আমার বিকালগুলো কাটে তখন টিউশনি করে। কখনোবা দীননাথ সেন রোডের ওদিককার পাঠাগার ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’-এ বই পড়ে।

আমি ছোটবেলা থেকেই অপদার্থ টাইপের। কোনো খেলাধুলাই পারতাম না। এমনকি সাইকেলটা পর্যন্ত চালাতে শিখিনি। বন্ধুরা ধুপখোলা মাঠে ফুটবল ক্রিকেট খেলে, আমি খেলতে পারি না। খেলা একটাই একটু পারি, সেটা ব্যাডমিন্টন। শীতকালে মানবেন্দ্রদের বাড়ির লনে আমি মুকুল মোহাম্মদ আলী মানবেন্দ্র ব্যাডমিন্টন খেলতাম। কোনো কোনো দিন বেলালও খেলতে যেত। বেলাল ছাড়া আমরা সবাই ছিলাম গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের ছাত্র। মাহমুদ শফিকের সঙ্গে ভাব হলো। আমি একটু বইটই পড়ি, পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্যের খোঁজখবর রাখি। শফিক ভাবল, এই তো একজন পাওয়া গেছে। দিনরাত অবিরাম কবিতা লেখে সে, অবিরাম আমাকে পড়ে শোনায়। আমি বুঝি আর না বুঝি মুগ্ধ হওয়ার ভান করি। কবিতার শব্দ ব্যবহার, ছন্দ এবং ভিতরকার রহস্যময়তা নিয়ে শফিক তখন টগবগ করে ফুটছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এঁদের প্রত্যেকের কবিতা নিয়েই কথা বলে। আমি কবিতার কিছুই বুঝি না, তবু শফিকের কথায় তাল দিয়ে যাই। শফিক আমাকে এক দিন নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেল। ‘কালের পাতা’র অফিস ছিল সিরাজুল হক সাহেবের বাসায়। দেওভোগের ওদিকে। খালের ওপর কাঠের একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে হাতের বাঁ-দিকে টিনের বাড়ি। লম্বা মতন পাটাতন করা একটা ঘরে থাকেন সিরাজুল হক সাহেব। বিকালের মুখে সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছি আমি আর শফিক। লম্বা ঘরটির মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে দুটো রুম করা হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে একটা রুম দেখা যাচ্ছে। খাটে লম্বা মতন একজন মানুষ দরজার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে আর কিছু নেই। তাঁর সাদা পিঠ চকচক করছে। শফিক ফিসফিস করে বলল, ওই ভদ্রলোকই সিরাজুল হক। সেই প্রথম একজন লেখক এবং সম্পাদককে দেখলাম আমি। তার আগে, ছেলেবেলায় আব্বা আমাকে একজন লেখক দেখিয়েছিলেন। আমরা তখন থাকি জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। বাষট্টি-তেষট্টি সালের কথা। সংসার বড় হচ্ছে দেখে মা আমাকে রেখেছিলেন বিক্রমপুরে, আমার নানির কাছে। মাঝেমাঝে ঢাকায় আসতাম। ঢাকায় আমাদের তখন বেড়ানোর জায়গা মানে সদরঘাট। জিন্দাবাহার থার্ড লেন থেকে বেরোলেই আহসান মঞ্জিলের উত্তর দিককার গেট। আমরা বলতাম ‘নোয়াববাড়ি’। নোয়াববাড়ির সেই গেট দিয়ে ঢুকলে সোজাসুজি বুড়িগঙ্গার তীরে আহসান মঞ্জিল। পশ্চিম পাশে একটা মসজিদ। পুবপাশে বিশাল খেলার মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান দিয়ে পুবদিকে আর একটা বিশাল উঁচু গেট। ওই গেট দিয়ে বেরিয়ে, ওয়াইজ ঘাটের ওদিক দিয়ে সদরঘাটে চলে যাই আমরা। সদরঘাটে তখনো টার্মিনাল হয়নি। বাকল্যান্ড বাঁধের মাঝখান দিয়ে পায়েচলা পথ নেমে গেছে বুড়িগঙ্গার দিকে। বালিয়াড়ির ওপর পড়ে থাকে সাগরকলার খোসা, ডাবের খোসা। লঞ্চগুলো দাঁড়িয়ে থাকে নদীতীরে। কাঠের লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে বালিয়াড়িতে। অদূরে বজরার মতো অনেক নৌকা। সেসব নৌকার কোনোটায় লেখা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, কোনোটায় লেখা ‘পাইস হোটেল’। এই বালিয়াড়ির ওপর এক বিকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম এক ভদ্রলোককে। পরনে ময়লা পায়জামা আর খদ্দরের ধূসর পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা ঝোলা। মুখে দাড়িগোঁফ, চোখে চশমা। পায়ে চপ্পল। আব্বা আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন সদরঘাটে। হাঁটতে হাঁটতে ওদিকটায় গেছি আমরা। ভদ্রলোককে দেখিয়ে আব্বা বললেন, ‘ওই ভদ্রলোক একজন লেখক। বই লেখেন।’ কী ধরনের বই লেখেন, কী নাম সেসবও বলেছিলেন কি না মনে নেই। তবে ওই প্রথম আমি একজন লেখককে দেখি। কিন্তু লেখক এবং সম্পাদক, একজন মানুষই যে দু দুটো ক্ষেত্রে কৃতী, সেটা দেখলাম সিরাজুল হক সাহেবকে। তাও মুখটা দেখতে পেলাম না। দেখলাম পিঠটা।

মুজিবুল হক কবীরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো মাহমুদ শফিকের মাধ্যমে। সেই বিকালে আমরা আর কবীরদের বাসায় বসিনি। প্রথমে গেলাম ‘বোস কেবিনে’। কবীরের বন্ধুবান্ধব কাউকে সেখানে পাওয়া গেল না। চাষাঢ়ার ওদিকে ‘সুধীজন পাঠাগার’ নামে একটা পাঠাগার হয়েছে। বিকালবেলা ওই পাঠাগারে বসে বই পত্রপত্রিকা পড়ে কবীরের বন্ধুরা। পাঠাগার পর্যন্ত যেতে হলো না। পাঠাগারের একটু আগে ‘আলম কেবিন’ নামে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সেই রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতে তিন-চারজন যুবক বসে আছে। প্রত্যেকের পোশাক-আশাক এলোমেলো। মাথায় লম্বা চুল। কারও কারও হাতে সিগ্রেট। একজন বেশ উঁচু লম্বা, মোটা ধাঁচের। কবীর পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম মুহসিন। আরেকজন যুবক একটু বেটেখাটো, টকটকে ফর্সা গায়ের রং। মাথার চুল বাদামি। চেহারা খুবই সুন্দর। তার নাম মাহবুব কামরান। সে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। দুষ্টের শিরোমণি বলতে যা বুঝায়, তাই কামরান সম্পর্কে এই তথ্য জেনেছি পরে। মুহসিন বিশাল ধনী পরিবারের ছেলে। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ‘জামাল সোপ ফ্যাক্টরি’ মুহসিনদের। তৃতীয় যে যুবকটি সেদিন আলম কেবিনের ফুটপাতে বসেছিল তার নাম হুমায়ূন ফরীদি। পরনে সাদা ঢলঢলে একটা শার্ট, কালো প্যান্ট। দুটোই অতি ময়লা। ফরীদির পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ফুকফুক করে সিগ্রেট টানছিল। মাথায় লম্বা চুল। চেহারায় বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। মুহসিন আর কামরান হাসি-ঠাট্টা করছিল, মজা করছিল। কবীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরও আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। শফিকের সঙ্গে আগে থেকেই ওদের পরিচয়। আমাকে চিনল আজই। আমি তো কোনো লেখক কবি না। আমাকে পাত্তা দেওয়ার কী আছে?

সেই বিকালে আলম কেবিনের ফুটপাতে বসে আমিও খুব আড্ডা দিলাম ওদের সঙ্গে। দু-তিন কাপ করে চা খাওয়া হয়ে গেছে। পকেটের পয়সা ফুরিয়ে গেছে সবারই। মুহসিন চলে গেছে খানিক আগে। আবার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে সবার কিন্তু পকেটে পয়সা নেই কারও। কামরান বাকি খাওয়ার চেষ্টা করল। হলো না। শেষ পর্যন্ত ফরীদি বলল, ‘আমাদের বাসায় চল। বাসায় চা খাওয়াব।’ হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ফরীদিদের বাসায়। ধু ধু মনে হচ্ছে, বোধহয় দোতলায় নিয়ে আমাদেরকে তুলল ফরীদি। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটও পাঠালেন ফরীদির মা। ওই সময় বেশ কিছুদিন ফরীদির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আড্ডা ইত্যাদি হয়েছে। তারপর গ্যাপ পড়ে গেল। বাহাত্তর সাল গিয়ে তিয়াত্তর সাল এসেছে। আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়ে গেছে। নিয়মিত ‘সুধীজন পাঠাগারে’ যাই বই আনতে। পাঠাগারের মেম্বার হইনি। কবীর কামরান ওরা বই তুলে দেয়। বাসায় এনে পড়ে তিন চার দিন পরপর গিয়ে ফেরত দিয়ে আসি। নতুন বই আনি। বেশ একটা উন্মাদনার মধ্যে আছি। সবার সঙ্গেই দেখা হয়, ফরীদির সঙ্গে হয় না। আমার সেভাবে মনেও পড়ে না ফরীদির কথা। লেখার উন্মাদনায়, নতুন নতুন বন্ধু পেয়ে ফরীদির কথা আমি ভুলেই গেলাম।

পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে ফরীদির সঙ্গে আবার দেখা হলো। ঢাকা থিয়েটারের রিহার্সেল হয় তখন জোনাকী সিনেমা হলের ওই রাস্তায়, এখনকার গাজী ভবনের পশ্চিম পাশের একটা বাড়িতে। বাড়িটা সম্ভবত শহীদ আলতাফ মাহমুদের। সেলিম আল দীন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি, আল মনসুর, আসাদ, শিমুল ইউসুফ (তখন শিমুল বিল্লাহ) হাবিবুল হাসান, সুবর্ণা মুস্তাফা, নূপুর, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে পাওয়া যায় ওখানে। আফজালও ঢুকেছে ঢাকা থিয়েটারে। তার সঙ্গে আমি আর আবদুর রহমান যাই রিহার্সেল দেখতে। রহমানের ওপর পড়েছে ঢাকা থিয়েটারের কিছু টিকিট বিক্রির ভার। এখানে ফরীদির সঙ্গে আবার দেখা হলো। সে তখন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সে অনার্স পড়ছে। বোধহয় অনার্স শেষবর্ষের ছাত্র। আফজালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কোথাও। ফরীদির অভিনয় বোধহয় কোথাও দেখেছিল আফজাল। দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে এসেছিল ঢাকা থিয়েটারে। সেলিম আল দীনের মাস্টারপিস ‘শকুন্তলা’য় অভিনয় করে দর্শকদেরকে তাক লাগিয়ে দিল ফরীদি। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। তারপর একের পর এক মঞ্চনাটক। সবগুলোই সেলিম আল দীনের। টেলিভিশনেও সেলিম আল দীনের নাটকে অভিনয় করতে লাগল। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আমাদের সবার প্রিয় বাচ্চুভাই তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রডিউসার। তিনি প্রডিউস করেন, সেলিম ভাই লেখেন, ফরীদির অভিনয়। জীবন একসঙ্গে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে চলে। মঞ্চে সেলিম বাচ্চু জুটির নাটক, টিভিতেও তাই। ফরীদির পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। ‘ভূত’ নামে একটা মঞ্চনাটকের নির্দেশনাও দিল ফরীদি। এসব আরও পরের ঘটনা। তার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরীদির হলে আফজালের সঙ্গে দুয়েকবার গিয়েছি। সেলিম আল দীন জয়েন করেছেন নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। ফরীদি আফজাল ওদের সঙ্গে আমিও গিয়ে উঠেছি সেলিম ভাইর কোয়ার্টারে। বসার ঘরের মেঝেতে ঢালাও বিছানা করে দিয়েছেন পারুল ভাবী। রাত দুটা-তিনটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে শুয়েছি আমরা। অনেকটা বেলা করে উঠেছি। তারপর আবার আড্ডা। পারুল ভাবী খিচুড়ি রেঁধে দিয়েছেন। কাপের পর কাপ চা পাঠিয়েছেন। হায়রে আমাদের সেই সুখের দিন! ভাবলে সুনীলের কবিতার লাইন মনে আসে, ‘সেই সুখের দিন কে আমায় ফিরিয়ে দেবে!’ ফরীদির প্রথম বিয়ের কথা আমার সেভাবে মনে নেই। শুধু মনে আছে বেলীফুলের মালা দিয়ে ফরীদি বিয়ে করেছিল। তখনকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ এই নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল। ফরীদির তখনকার জীবন, তার একমাত্র সন্তানের জন্ম, বিস্তারিত আমার মনে নেই। আমি তখন লেখক হওয়ার জন্য এতটাই ব্যতিব্যস্ত, অনেক প্রিয়বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ কমে গেছে। আমার তখন বন্ধুত্ব হচ্ছে লেখক কবিদের সঙ্গে। কবি রফিক আজাদ আমার সময়ের অনেকখানি নিয়ে নিচ্ছেন। ফরীদি বোধহয় তখন এলিফ্যান্ট রোডের ওদিককার একটা বাড়ির তিনতলায় স্ত্রী-কন্যা নিয়ে থাকে। ছোট্ট ফ্ল্যাট। সামনে অনেকটা খোলা ছাদ। ওই বাসাটায় এক দিন আমি গিয়েছিলাম।

ফরীদির সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়েছে একটা সময়ে। সেটা পঁচাশি ছিয়াশি সাল। ’৭৯ থেকে ’৮১ এই দুই বছর জার্মানিতে কাটিয়ে আমি দেশে ফিরেছি। ’৮২ সালে বিয়ে করলাম কিন্তু রোজগারপাতি কিচ্ছু নেই। ‘রোববার’ পত্রিকায় চাকরি করতাম, সেটা চলে গেছে। জার্মানি থেকে টাকা পয়সা রোজগার করে আনতে পারিনি। বড় ভাইয়ের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছি। পরিবারের সবাই আমার ওপর চটা। একে রুজিরোজগার নেই, তার ওপর বিয়ে করেছি। স্ত্রী বেচারি আছে গভীর অশান্তিতে। ইউসুফ হাসান নামের একজন তরুণ আর্টিস্টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ধানমন্ডি চার নম্বর রোডের ‘চুংকিং’ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সে আমাকে এক দিন নিয়ে গেল। রনি আপা, শান্তি ভাই এই জুটি হচ্ছেন রেস্টুরেন্টটির মালিক। ‘চতুরঙ্গ’ নামে তাঁরা একটা মাসিক পত্রিকা বের করেন। একটা সংখ্যা বেরিয়েছে। ইউসুফ দেখাশোনা করে পত্রিকাটি। তার সঙ্গে আমাকে কাজে নিল ইউসুফ। রনি আপা, শান্তি ভাই দুজনেই আমাকে পছন্দ করলেন। এই দুজনই ফরীদির বন্ধু। ফরীদি তখন খুবই অস্থির সময় কাটাচ্ছে। ধানমন্ডির একটা ফ্ল্যাটে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সুবর্ণার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। প্রতিদিন দুপুরের দিকে ফরীদি চলে আসে চুংকিংয়ে। রনি আপার সঙ্গে, আমার সঙ্গে বসে আড্ডা দেয়। মিনিটে মিনিটে সিগ্রেট ধরায়। কী যে অস্থির! কোনো কোনো দিন সুবর্ণাও আসে। ফরীদির বাসায় তখন মাসুক হেলাল থাকত। স্ত্রীর সঙ্গে সেপারেশন চলছে। কন্যা আছে স্ত্রীর কাছে। তারপরের ঘটনা সবাই জানে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, সুবর্ণার সঙ্গে বিয়ে, সংসার ইত্যাদি।

আর একটু পেছনে ফিরি। টেলিভিশনে আমার প্রথম নাটক ‘মায়াকানন’। আফজাল সুবর্ণা জুটি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এ জুটির অভিনয়ের ফলে ‘মায়াকানন’ তুমুল জনপ্রিয় হলো। প্রথম নাটকেই লোকে আমাকে চিনে ফেলল। আমার দ্বিতীয় নাটক ‘সখা তুমি সখী তুমি’। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন জিয়া আনসারি। প্রযোজক ফখরুল আবেদীন দুলাল। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ নামে হিন্দুয়ানা আছে, এজন্য নাম বদলে করতে হলো ‘সখা তুমি সখী তুমি’। নাটকে জুটি হলো সুবর্ণা ফরীদি। নাটক রীতিমতো সাড়া ফেলে দিল। ডব্লিউ. এইচ. অডেনের একটা কবিতার লাইন ব্যবহার করা হলো নাটকে, WE MUST LOVE ONE ANOTHER OR DIE. এই লাইন তখনকার যুবক-যুবতীদের মুুখে মুখে ফিরতে লাগল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কয়েকটি ছেলে সাদা টি-শার্টে কবিতার লাইনটি লিখে ঘুরে বেড়াল। আর্ট কলেজের দেয়ালে লেখা হলো এই লাইন। বোধহয় অডেনের লাইনটি ফরীদি সুবর্ণার জীবনেও প্রভাব ফেলল। তাদের সম্পর্ক তৈরি হলো এই নাটক করতে গিয়ে। ফরীদি ইংরেজি বাংলা দুটোই ভালো জানে। টুকটাক কিছু লেখাও আছে তার। কবিতা নাটক উপন্যাস, গ্রিক পুরাণ, ধর্মবিজ্ঞান, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থনীতি- ফরীদি পড়েছে সবই। আমার কাছ থেকে শীর্ষেন্দুর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুনপোকা’ পড়তে নিয়ে হারিয়ে ফেলল। আমি রেগে গিয়ে ‘বালখিল্য’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম। কত আগের কথা। ফরীদি বহুদিন সে কথা মনে রেখেছিল। অতি প্রখর স্মৃতিশক্তির মানুষ ছিল সে।

একসময় যাত্রাদলের সঙ্গে ঘুরেছে কিছুদিন। অতি বোহেমিয়ান জীবন। ফরীদির হৃদয়ের মাপটা একটু বড়ই। বেশ বড়। যখন সিনেমায় অভিনয় করে লাখ লাখ টাকা রোজগার করছে, বন্ধুবান্ধব কেউ অসুবিধায় আছে, হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা ফরীদি তাদের দিয়েছে। কে ফেরত দেবে, কে দেবে না, ভাবেনি। মনে রাখেনি টাকার হিসাব। আবার হয়তো কেউ একজন সচ্ছল বন্ধু হঠাৎই দুশো টাকা নিয়েছে, নিয়ে ভুলে গেছে, ফরীদি হয়তো পাঁচ বছর পর হঠাৎ তাকে এক দিন বলল, ‘ওই, তর কাছে যে দুইশো টেকা পাই, দিলি না?’ ফরীদি খেত খুব কম কিন্তু খাদ্যরসিক বলতে যা বোঝায়, সে ছিল তাই। আইড় মাছের একটা প্রজাতি একটু কুঁজো ধরনের। আঞ্চলিক ভাষায় সেটাকে বলে ‘গুজিআইড়’। খেতে অসাধারণ টেস্টি। ফরীদির খুব প্রিয় ছিল এই গুজিআইড়। রহমান নামে একজন কেয়ারটেকার ছিল ফরীদির। কেয়ারটেকার বলব, না কী বলব রহমানকে? ফরীদি সুবর্ণার সংসারের সবকিছুই সে সামলাত। সিনেমায় অভিনয় করে ফরীদি তখন লাখ লাখ টাকা রোজগার করছে। সুবর্ণা আছে টেলিভিশন নিয়ে। সকালবেলা দুজন বেরিয়ে যাচ্ছে দুদিকে। রহমান সামলাচ্ছে সব। আলমারিতে লাখ লাখ টাকা। সেই আলমারির চাবি রহমানের কাছে। সে টাকা বের করছে, খরচা করছে, ফরীদি হিসাবও নিচ্ছে না। হিসাব নেওয়ার অবশ্য ছিলও না কিছু। রহমানের সততার কোনো তুলনা নেই। আর ফরীদির কী যে ভক্ত সে! রহমান রান্না করত অসাধারণ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর