শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সন্তান বেড়ে উঠুক দুধেভাতে

শাইখ সিরাজ

সন্তান বেড়ে উঠুক দুধেভাতে

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’-প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ সমৃদ্ধি বলতে বুঝেছে সন্তানকে দুধেভাতে রাখার মতো সচ্ছলতা। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৃষির অন্য খাতগুলো যতটা এগিয়েছে ততটা এগোয়নি ডেইরি শিল্প।

আজ (১ জুন) বিশ্ব দুধ দিবস। বহু বছর ধরেই বলা হচ্ছে দুগ্ধশিল্প বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এই শিল্পটি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। আমরা যেখানে বলছি টেকসই উন্নয়নের কথা, বলছি সব মানুষের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করার কথা। সেখানে দুধের উৎপাদন চাহিদার বিপরীতে এখনো অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ ২০৮ মিলিলিটার পাচ্ছে। দেশে এখন উৎপাদন ঘাটতি ২৫ লাখ টনের বেশি।

দুগ্ধশিল্প আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির একটি বড় অংশ। পুষ্টিরও অন্যতম বড় উৎস হলো দুধ। গরুর দুধে আছে অ্যামাইনো এসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন-ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিঙ্ক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। দুধের পুষ্টিই মানুষের দৈহিক গঠন, মানসিক বিকাশ ও মেধা বাড়াতে সহায়ক।

দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের ‘আমূল’-এর আদলে ‘মিল্কভিটা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ভারতের দুগ্ধশিল্পে আমূল যতটা সফল হয়েছে মিল্কভিটা ততটা সফল হয়নি। মনে পড়ে আমূল জনপ্রিয় করতে সে সময় শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ভারতের প্রথম ক্রাউডফান্ডে নির্মিত ‘মন্থন’ সিনেমা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সিনেমা নির্মাণে পাঁচ লাখ কৃষক প্রত্যেকে দুই রুপি করে দিয়েছিল।

দুধ উৎপাদন কাক্সিক্ষত পরিমাণে না হলেও নতুন নতুন জাতের গরু পালনের ফলে বেড়েছে দুধের উৎপাদন। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টন। তবে এতে দেশে দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। কারণ, দেশে বছরে চাহিদা ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার টন। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাজারে দুধের দামের সঙ্গে গাভি পরিচালনা ব্যয়ের পার্থক্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষুদ্র খামারি বা যাদের একটি বা দুটি গাভি রয়েছে তারা উৎসাহ হারাচ্ছেন।

বিভিন্ন সময় দুগ্ধ খামারিদের নানা দাবি আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছি। বিশেষ করে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে খামারিরা সরকারের মন্ত্রী ও বিভিন্ন প্রতিনিধির সামনে তাদের দাবি তুলে ধরেন। এ বছর উত্তরবঙ্গের কৃষক ও খামারিরা যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন সেগুলো হলো-

১. প্রাণী খাদ্যের দাম কমাতে হবে। বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। ইচ্ছামতো মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হবে। প্রাণী খাদ্যের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে।

২. বিদেশ থেকে দেদার গুঁড়োদুধ আসছে। বৈধ ও অবৈধ পথে গুঁড়োদুধ আসার কারণে দেশীয় দুগ্ধ খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দুধের দাম পাচ্ছেন না তারা। একই সঙ্গে গোখাদ্য ও শ্রমিক খরচ বাড়ছে। এতে সামগ্রিকভাবে দুধের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বাইরে থেকে গুঁড়োদুধ আমদানিতে শুল্ক আরোপসহ সব অনিয়ম দূর করা প্রয়োজন।

৩. দুগ্ধ খামারিদের জন্য বীমা ব্যবস্থা চালুর দাবি তুলেছেন খামারিরা।

৪. দেশের দুগ্ধখামার সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও চিলিং প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের মাধ্যমেই বিভিন্ন এলাকায় দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে।

৫. সারা দেশে দুধের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত করার দাবি ছিল ক্ষুদ্র খামারিদের। এ ছাড়াও খামারিরা বলছেন, সহজে ঋণ না পাওয়া, খামারিদের বিশেষজ্ঞের পরামর্শসহ সরকারি সেবা না পাওয়া, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ না করা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক সংকট, দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে না পারা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং বিদ্যুতের মূল্য কৃষিভিত্তিক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া ইত্যাদি কারণে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না।

প্রাণিখাদ্য হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত খাদ্য উপাদান হলো গমের ভুসি। গত বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্য মতে, শুধু এক বছরে গমের ভুসির দাম বেড়েছে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ। গমের ভুসির পাশাপাশি দাম বেড়েছে ভুট্টা, সরিষার খৈল, ধানের কুঁড়া এবং সয়াবিনের। ভুট্টা ৯০ শতাংশ, সরিষার খৈল ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ধানের কুঁড়া ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ, সয়াবিন মিল ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামারিরা অনেক সময় খরচের জোগান দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে গরু বিক্রি করছেন। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল অবধি পাঁচ বছরের জন্য প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প নামে ৪২৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিচালনা করে। যে প্রকল্পটির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের একটি ছিল- ৫৫০০ প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদনকারী সমিতি (প্রডিউসার অর্গানাইজেশন) গঠন এবং পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে মার্কেট লিংকেজ ও ভেলু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে সে বিষয়ে কথা হয় প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি জানান, ডেইরির জন্য আরও ১ হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতি তারা গঠন করেছেন। দেশে ২০টি ডেইরি হাব ও চিলিং স্টেশন তারা নির্মাণ করেছেন। ২৪৮টি অফিসে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছেন।

যে কোনো কৃষিপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও উৎপাদকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভেলু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। আমরা দেখেছি দেশের যে অঞ্চলগুলোতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহের হাব আছে, সে অঞ্চলগুলোতে খামারিদের সন্তুষ্টি তুলনামূলক বেশি। প্রাণিসম্পদ খাতে বীমা খামারিদের দীর্ঘদিনের দাবি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে এই খাতে বীমা বিষয়ে কার্যক্রম থাকলেও তার কার্যকারিতা দেখা যায়নি।

আমাদের উৎপাদিত দুধের মান নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। দুধে সিসা ও অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান পাওয়া যায় বলে অভিযোগ উঠেছে বহুবার। পাশাপাশি দুধের ঘাটতি পূরণে প্রতিবছর ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার গুঁড়োদুধ আমদানি করতে হয়। আমদানি করা গুঁড়োদুধের মান নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সুষম খাদ্য হিসেবে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে বোর্ড প্রতিষ্ঠার জন্য গত বছর জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড বিল-২০২৩ পাস হয়েছিল। আশার কথা হচ্ছে, এ খাতে শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছেন শিল্প উদ্যোক্তারাও। ফলে দেশে বেশ কিছু আধুনিক খামার তৈরি হয়েছে। তাদের উদ্যোগেই অদূর ভবিষ্যতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী খামার ব্যবস্থাপনা শুরু হবে ব্যাপক আকারে। সে ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত নীতি সহযোগিতা দিয়ে সরকারের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি অন্য খামারিদেরও আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত করতে প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ এবং সুস্থ বাজার ব্যবস্থাপনার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তবেই আমাদের ডেইরি খাত উন্নত হবে, বিকশিত হবে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত শিল্প। আমরা বিশ্বাস করি এক দিন আমাদের দেশের সব সন্তান বেড়ে উঠবে দুধেভাতে, সুষম পুষ্টি পেয়ে সুস্বাস্থ্য নিয়ে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর