শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

তরুণদের তামাকের নেশামুক্ত রাখতে হবে

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

তরুণদের তামাকের নেশামুক্ত রাখতে হবে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ পালনে এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ, শিশু-কিশোর, তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।

কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এ কারণেই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পণের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! ঝুঁকিপূর্ণ এ জন্যই যে, অল্প বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তোবা তার উপলক্ষ থাকে কোনো একটি বিশেষ দিন অথবা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সেভাবে- আজ শুধু আনন্দ, ফুর্তি করব। কাল থেকে আর ধূমপান/মাদক গ্রহণ করব না, প্রতিজ্ঞা করব। ধূমপান, মাদকের নেশা খুবই ক্ষতিকর, মারাত্মক আসক্তি সৃষ্টি করে। সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও কৌতূহলবশত যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই তারা ভয়াবহ মাদকের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে, যদিও তারা অমিত সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এর ফলে সমাজে এখন ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে। যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকারপ্রধানের উদ্বেগ যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে আমাদের। শিশু-কিশোর, তরুণদের নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তারাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। জাতীয় অসংখ্য উদ্যোগ, লক্ষ্যমাত্রা এবং সেগুলোর সাফল্যও নির্ভর করছে তাদের ওপর। ভিশন ২০২১-এ সাফল্যের দেখা পেয়েছে সরকার। সেটার ওপর ভিত্তি করেই রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য নির্মূল, মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, পুষ্টি বৈষম্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা এ রূপকল্পের উদ্দেশ্য। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ২০৪১ সাল সমগ্র জাতির জন্য আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারণ ওই বছরেই উন্নত সমৃৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হবে আমাদের মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ লক্ষ্যমাত্রাও সেই একই বছরে। উপরন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে ‘তামাকমুক্ত দেশ’। তামাকের মতো অভিশাপ ও প্রতিবন্ধকতামুক্ত উন্নত, সমৃৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো উন্নয়ন বা উদ্যোগ জনগণকে পাশ কাটিয়ে হতে পারে না। বিশেষ করে এক্ষেত্রে শিশু-কিশোর, তরুণদের উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কেননা, আমাদের সার্বিক উন্নয়নে ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হবে হালের অল্প বয়সিরা। কৈশোর, তারুণ্যের মুনশিয়ানা অনেক চমকপ্রদ হয়ে থাকে। আমরাও সে আলোকেই আশাবাদী হয়ে আছি। তবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কতটা সাবধানতা অবলম্বন করছি তা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে। কারণ, শিশু-কিশোর, তরুণদের বিপথগামিতা সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা থেকে উত্তরণে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আর সে পরীক্ষায় বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো। যারা ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার হিংস্র নেশায় আমাদের শিশু-কিশোর, তরুণদেরই বেছে নিয়েছে! প্রতিদিনই তারা বিভিন্নভাবে কিশোর-তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে নানা প্রলোভন দেখাচ্ছে।

সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরও একটা অংশ রয়েছে, যারা এ গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এ বদঅভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এ সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!

তামাক থেকে কিশোর-তরুণদের রক্ষায় রাষ্ট্র ও পরিবারের দিক থেকে কোনো গাফিলতি করা যাবে না। কেননা, তামাক কোম্পানির মতো ধূর্ত হায়েনারা আমাদের শিশু-কিশোরদের ধরতে ওত পেতে বসে আছে। তাদের কূটচালে এ বিপুল জনগোষ্ঠী যদি জাতীয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সমস্যায় জর্জরিত হবে রাষ্ট্র। সমস্যা থেকে উত্তরণ ও দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনী পাস করে বাস্তবায়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা পাওয়ার কথা তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণদের নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই আসুন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের অপকৌশল প্রতিহত করার অঙ্গীকার করি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

সর্বশেষ খবর