ছেলেবেলায় লেখাপড়ার প্রতি তেমন আকর্ষণ ছিল না, বোধ-বিবেচনাও ছিল খুবই ভোঁতা, নিম্নমানের। লেখাপড়া যে একটা মারাত্মক আনন্দের এটা কচি বয়সে বুঝতেই পারিনি। আমাদের কলিজার টুকরো কুশিমনি প্রথমদিকে স্কুল নিয়ে ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটি করে বাড়িসহ সারা মহল্লা মাথায় তুলত। সেই কুশিকে দেখেছি এক-দুই বছর স্কুলে যেতে না যেতেই স্কুলের সময় হলে আমাদের বকাঝকা করত, নানাভাবে শাসাত, ‘স্কুলের সময় হয়েছে তোমাদের সেদিকে খেয়াল নেই, তোমরা কিছুই বুঝ না, তোমাদের নিয়ে আর পারি না।’ তার এখন ও-লেভেলের আর একটি পরীক্ষা মাত্র বাকি। একইভাবে বাড়িতে থাকার চাইতে স্কুলে যাওয়া তার জন্য আনন্দের। অমন আনন্দ আমার জন্য ছিল না। আমার জন্য ছিল হাতে-পায়ে পিঠে বেত আর বেত। গতকাল বাসাইল উপজেলা নির্বাচনি প্রচারে গিয়েছিলাম আইসড়াতে। একসময় আইসড়া স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন আলী আহমেদ স্যার। ১৯৬০-’৬২ সালে আমি যখন বরাটি নরদানা পাকিস্তান হাইস্কুলে পড়তাম তখন তিনি বরাটি স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন। অসাধারণ মেধাবী শিক্ষক। পড়া না পারলে দুটা বেত মারতেন। কৃষকরা হাল বাইতে গিয়ে গরু-মহিষকেও অত জোরে মারে না। পরে তিনি হয়েছিলেন আইসড়া স্কুলের হেডমাস্টার। স্বাধীনতার পর যতবার স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে অস্বস্তিবোধ করতেন। আমি সেটা বুঝে স্যারকে অনেকবার বলেছি, আপনার কাছে আমি যখন পড়তাম তখন তো আমি ছিলাম গরু। আপনারাই আমাকে মানুষ বানাতে চেষ্টা করেছেন তাই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছি। আপনি তো আমার গুরু। গুরু গুরু-ই। তার আবার অস্বস্তি কেন? আমার কথায় তিনি ভরসা করতেন। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বস্তি পেতেন না। সেই স্মৃতিবিজড়িত আইসড়া-ফুলকি-ঝনঝনিয়া-কাউলজানি- কাঞ্চনপুর নির্বাচনি প্রচারে গিয়েছিলাম। আজকের রাত পোহালেই বাসাইল-সখীপুর উপজেলা নির্বাচন। বাসাইলে আমাদের দলীয় প্রার্থী ছিল না। তাই প্রায় ১০ বছর বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত একজন আদর্শ শিক্ষক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, শালীন সুশীল, নিরেট ভদ্রলোক কাজী শহীদকে দোয়াত-কলম মার্কায় আমরা সমর্থন করেছি। মিরিকপুর-নাইকানবাড়ি-সুন্না-ঈশ্বরগঞ্জ-কাঞ্চনপুর-মটরা সব জায়গায়ই মানুষের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ লক্ষ্য করেছি।
গতকাল ঘুম থেকে উঠে ছাদে অনেকটা সময় পায়চারি করে চা খাচ্ছিলাম। মনে হয় নাশতা খাওয়াও শেষ হয়েছিল। তখন খবর পেলাম বীরপ্রতীক হামিদুল হকের ছেলে এসেছে। পরে বুঝলাম শুধু ছেলে নয়, মেয়ে এবং মেয়ের জামাইসহ তিনজন এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে হামিদুল হক বীরপ্রতীকের অবদান আসমানসম। কিন্তু সেই পরিমাণ সম্মান মর্যাদা কিছুই তিনি পাননি। যখন মারা যান তখন কোনো সমাজসেবী সংস্থা ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিল। সরকার তেমন দেখভাল করেনি। তার স্ত্রীও কয়েকদিন আগে মারা গেছেন। তেমন অযত্ন না হলেও খুব একটা যত্ন পাননি। আমরা যতই বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। চেতনা নিয়ে অবশ্যই আলাপ-আলোচনা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বা তাদের সুখ-শান্তি নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না। হামিদুল হকের মেয়ে এসেছিল। আজ তার প্রাইমারি শিক্ষক হিসেবে জেলা প্রশাসকের দফতরে মৌখিক পরীক্ষা। মেয়েটির নাম তাসলিমা আক্তার রুমা, পিতা- হামিদুল হক। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার বাবার নাম হামিদুল হক? তোমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দরখাস্তে হামিদুল হক আছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছে। সবাই মুক্তিযুদ্ধে সাহসী খেতাব পায়নি। তোমার বাবা বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। কোথায় সে বীরপ্রতীক? তুমি জন্মেছ ’৮৯ সালে। তোমার বাবার খেতাব রাষ্ট্রীয় গেজেটে উঠেছে ’৭৩ সালে। স্কুল কলেজে ভর্তির সময় সে নাম নেই কেন? কোনো জবাব নেই। বছরখানেক আগে একদিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘জানেন লিডার, আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাই আমাদের আর কিছু করতে হবে না। সব মুক্তিযোদ্ধাই এত উদাসীন এত অলস নিজের নামটাও ভালো করে লিখতে চান না। এক্ষেত্রেও দেখলাম প্রায় তাই। বাবা একজন বীরপ্রতীক দয়া করে তা উল্লেখ করেনি। বহু বছর পর হঠাৎই সেদিন আউয়াল সিদ্দিকী ফোন করেছিলেন, ‘স্যার, আমার ভাস্তি প্রাইমারিতে পরীক্ষা দিয়েছে। আপনি যদি একটু বলতেন।’ আউয়াল সিদ্দিকী একজন বেশ বড় মাপের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অসাধারণ। আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য রাত-দিন কাজ করেছেন। সখীপুর-বাসাইলের প্রধান নেতা ছিলেন আউয়াল সিদ্দিকী। হামিদুল হকের সমসাময়িক শওকত মোমেন শাজাহানের চাইতে অনেক বড়। সেই মানুষের একটা অনুরোধ রাখব না, তা নিয়ে বলব না- এটা কী হয়? তাই নিজে গিয়ে বলে এসেছিলাম। হামিদ সাহেবের মেয়ে রুমার এইচএসসি এবং ডিগ্রির ফলাফল ভালো কিন্তু এসএসসির ফলাফল তেমন ভালো না। কিন্তু আউয়াল সিদ্দিকীর ভাস্তির এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স সবই প্রথম শ্রেণি, খুবই ভালো। এ কথা হামিদুল হক সাহেবের ছেলেমেয়েকে বলতেই প্রায় হামিদ সাহেবের মতোই তার ছেলে বলে উঠল, এ তো বেশি পাস, এর এ চাকরিতে আসাই উচিত না। এক অর্থে হয়তো হামিদ সাহেবের ছেলের কথাই সত্য। আরেক অর্থে যেহেতু সে এসেছে তার যোগ্যতা থাকতেও সে যদি বাদ পড়ে তাহলে এটা ন্যায় ও সত্যের বিচারে মারাত্মক অন্যায় হবে। কে ভাবে কার কথা? আজকাল কেমন যেন আমরা নিজেরা শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি একটা মেয়েকে সন্তানের মতো ভালোবাসি। আমি অমন তুখোড় কোনো ছাত্রী দেখিনি। গত আট-দশ বছরে যখন যেটা বা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বাচ্চাটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। দু’একটা বিষয় আমার জ্ঞানের অভাব থাকলেও তার কোনো অভাব দেখিনি। সে দু’বার বিসিএস দিয়েছে। ১-২ নম্বরের জন্য সে সব সময় পিছিয়ে পড়েছে। ক্যাডারে নয়, তার নাম এসেছে নন ক্যাডারে। অথচ আমার ধারণা সে এই সময়ে ক্যাডারদের মধ্যে থাকলে হয়তো সব থেকে ভালো হতো। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেক ক্ষেত্রে এমনই হয়। আমি যখন নির্বাসনে বর্ধমানে ছিলাম তখন আমাকে ছয়-সাতজন শিক্ষক সকাল-বিকেল পড়াতেন। আমার নাম-ধামের জন্য অনেক শিক্ষকেরই জড়তা ছিল। এর মধ্যে একজন খুবই হতদরিদ্র বিহারের মাইথনের লোক, বাবা মুদির দোকান করে। আমার থেকে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রতিবেশী একজনের সুপারিশে তাকে ইংরেজি শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলাম। অসাধারণ। খুব সম্ভবত আমাকে তিনি আট-নয় মাস পড়িয়ে ছিলেন। যে আমি is, was, has, have, had এসবের অর্থ বুঝতাম না, সেই আমাকে তিনি অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা পড়তে শিখেছিলাম, দুই-চার লাইন লিখতেও শিখেছিলাম। এরপর দেশে ফিরলে কিছুদিনের জন্য আমার শিক্ষক হয়েছিল ছোটবোন রহিমার ছেলে ক্লাস নাইন বা টেনের ছাত্র গালিব। সেও আট-নয় মাস পড়িয়ে ছিল। গালিব যদি আমাকে আর এক বছর পড়াতে পারত ইংরেজিতে আমার যে দুর্বলতা তা পুরোটাই কেটে যেত। সেই বর্ধমানের শিক্ষক আমাকে বেশি দিন পড়াতে পারেনি। সে এমএ পাস করে আমাকে যখন পড়াত সংসারে ছিল তাদের ভীষণ টানাটানি। তার ৩০০ টাকা মাসিক মাসোহারা ছিল। আমি তার কাছে দুই মাস পড়ার পরই ৫০০ টাকা করে দিতাম। তিনি যখন আইসিএস পরীক্ষা দিতে দিল্লি যান তখন তাকে ২০০০ টাকা দিয়েছিলাম। আল্লাহর কি অসীম দয়া, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে চাকরি পেয়ে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করে সচিব পর্যন্ত হয়ে অবসরে গেছেন। এই হলো আমার জীবনের কড়কড়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে আমি ভালোবাসি, ¯ন্ডেœহ করি, গুরুত্ব দিই। সরকারি লোকজনের কাছে তেমন যাতায়াত না থাকলেও দুই-চারজনের বাড়িঘরে যে যাই না, তা নয়। অনেক মন্ত্রীর বাড়িতে লোকজনের আকাল দেখেছি। কিন্তু আসাদুজ্জামান খানের ঘরে সব সময় লোকজন ঠেলেঠুলে ঢুকতে হয়। তাকে যেমন আমি ভালোবাসি, তিনিও তেমনি আমাকে অসম্ভব সম্মান করেন, গুরুত্ব দেন। ছোটখাটো যে কোনো কথা যখন বলেছি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে অসহায় তাও বুঝি। এরকম পরিস্থিতিতেও বেশ কয়েকবার আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কথা হয়েছে। মাসখানেক আগেও একবার গিয়েছিলাম। তাই তার অনেক ভুলত্রুটিই বলতে পারি না, বলতে চাইও না। কিন্তু বেনজীরকে নিয়ে তার বক্তব্য আমার কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো মনে হয়নি। তিনি যদি বেনজীরের খবর না জানেন তাহলে দেশের অস্তিত্ব থাকে কোথায়? হ্যাঁ, এটা ঠিক, বেনজীর বাইরে গেছেন, তিনি আসবেন কি আসবেন না সেটা ৬ তারিখ দেখা যাবে। তার জন্য আইন বসে থাকবে না। কিন্তু ওইভাবে বলা মোটেই শুভ নয়। অন্যদিকে সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি ভাই ওবায়দুল কাদের ২০০৩ সালে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে যখন দিল্লির এ্যাপোলোতে ছিলেন। হাসপাতালের বেড থেকে দুই হাত জড়িয়ে বলেছিলেন, কাদের ভাই, আমরা কি শেষ হয়ে যাব? এখনো সে কথা আমার বুকে বাজে। বর্তমানে সাবেক আইজিপি বেনজীর এবং সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজকে নিয়ে যা ঘটছে তাও দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি এভাবে কলঙ্কিত হলে ক্ষুণ্ণ হলে আমাদের মুখ দেখাবার কী থাকে? কেন যেন সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি কোনো ভরসা পাচ্ছে না, তাদের কোনো কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের, দেশের নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনার। আমরা কি সময় থাকতে সাবধান হব, সচেতন হব- নাকি ধ্বংসের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাব?
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com