শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের ভূত-ভবিষ্যৎ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

গণতন্ত্রের ভূত-ভবিষ্যৎ

২০২৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গণতন্ত্রকে ভারত ও আমেরিকার আরাধনা এবং চিন্তা-চেতনার মূলমন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বয়সে এবং ভারত ব্যাপ্তিতে বৃহৎ গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, Our partnership augurs well for the future of democracy. Together we shall give a better future to the world and a better world to the future. গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের স্বঘোষিত ও স্বপ্রণোদিত দুই মোড়লের মননে ও মেধায় চাণক্য পন্ডিত (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫-২৮৩) এবং আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫) যে ধারণা বা আদর্শের বীজ বপন করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক কম নয়। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত ও সামরিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। কী ধরনের চর্চা ও প্রয়োগের দ্বারা গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্মাণ কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, কিংবা খোদ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবয়বগত কোনো ধারণা তারা পোষণ করেন কি না তা বিস্তারিত বলার প্রাসঙ্গিকতা প্রধানমন্ত্রী মোদির সে দিনের সেই বক্তৃতায় ছিল না। বিশ্ব কূটনীতির ক্যানভাসে ভূ-রাজনীতির রং তুলিতে যে ভবিষ্যৎ পৃথিবী বাঙময় হয়ে উঠবে তার রূপরেখা দুই দেশেরই পক্ষে খোলাসা করা হয়নি, বলা যায় সম্ভবও নয়। গণতন্ত্রের ধারণা এবং এর বিকাশ ও বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য বিধয়ের মধ্যে রয়ে গেছে সীমাহীন গলদ কার্যকরণে ও বিস্তর ফারাক। তা গণতন্ত্র লালন-পালনে গণতন্ত্রের অপয়ার প্রতি ‘অন্ধ সমর্থন’ এবং ‘স্যাংশনের ভয়’ দেখানো সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।

২০২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের ‘বিশেষ বিতর্ক’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর যেমনটি বলেছিলেন, ‘‘দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নীতি হবে ‘শুধু’ পূর্বে তাকানো নয়, প্রাচ্যের দেশগুলোতে কার্যকরভাবে করণীয়তে তা রূপান্তর করা হবে।’’ জয়শঙ্কর আরও বলেছিলেন, ‘‘আমরা এখন থেকে জোট নিরপেক্ষ প্ল্যাটফরমের পরিবর্তে ‘বিশ্ব মিত্র’র মূল্যবোধে ও দর্শনে আচারী হব।’’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধর পাঁচ পরাশক্তির কারও বা তাদের মোর্চার মঞ্চের প্রতি না ঝোঁকার বা তাদের ক্রীড়নকে পরিণত না হওয়ার প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়েই ১৯৬১ সালে ভারতের জওহর লাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, মিসরের জামাল আবদুল নাসের প্রমুখরা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের যে মঞ্চ তৈরি করেছিলেন ভারতের বিশ্ব মিত্রর দর্শন স্বার্থে ও টানে পাঁচ পরাশক্তির সঙ্গে খাতির জমানোর অভিলাষের মধ্যে ভেস্তে যেতে বসেছে। ঠিক যে প্রকৃতির প্রশ্নে ভাগ হয়েছিল তদানীন্তন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালের ৮-১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত কাগমারি সম্মেলনে।

গত ৬ মার্চ ২০২৪ দ্য ডেইলি ব্যাংকক পোস্টে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়াস বুদ্ধিস্ট ডিপ্লোমেসি ইন অ্যাকশন’ লেখাটি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। তাতে বৃহৎ গণতন্ত্র ভারতের গণতন্ত্র আরাধনার সাম্প্রতিকতার স্বরূপ নির্ণয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রদত্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের উপরোক্ত মনোভাব উৎকলিত হয়েছে। এ নিবন্ধ রচনার পটভূমিতে টিটিপল থাইল্যান্ডের রাজার ৭২তম জন্মদিন (জুলাই ২৮) এবং মাখা বুচা দিবস (২৪ ফেব্রুয়ারি) পালন উপলক্ষে ভারত তাদের দেশে সংরক্ষিত গৌতম বুদ্ধ এবং তার প্রধান শিষ্য সারিপুত্রের দুটি মূর্তি থাইল্যান্ডকে প্রদর্শনের জন্য ‘ধার’ দিয়েছে। যা থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেশ থাইল্যান্ডে মূর্তি দুটির প্রদর্শনী বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ভারত তাদের দেশে থ্রি এ ক্যাটাগরিভুক্ত (অতি নিরাপদ সংরক্ষণযোগ্য এবং ভারতের বাইরে না পাঠানোর কড়া নির্দেশনা সত্ত্বেও) মূর্তি দুটি থাইল্যান্ডকে ফেরতযোগ্য ‘কর্জ’ দেওয়াকে টিটিপল ভারতের বৌদ্ধ কূটনীতির উদ্দেশ্য অভিসারী সফল প্রয়োগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা টিটিপল মনে করেন- ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চর্চার যে চরিত্র বিদ্যমান সেখানে থাইল্যান্ডে বৌদ্ধদের ধর্মীয় সমানুভূতি অর্জনের অভিপ্রায়কে বিশেষ বিচেনায় নিতেই হয়। টিটিপলের আরও ধারণা, ভারত-থাইল্যান্ডের ধর্মীয় বন্ধনের এই প্রয়াসের পেছনে লোয়ার মেকং বেসিনে ভারতের প্রতি তাদের মিত্রতার বন্ধন জোরদারের অভিপ্সা উৎসারিত হতে পারে। দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশ বা ইন্দো প্যাসিফিকের প্রভাব ভাগাভাগির প্রশ্নে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন একান্ত আলাপচারিতায় বসে তখন তাদের উভয়ের অভিন্ন প্রতিপক্ষ চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য গ্রহণের কূটকৌশলের অসাফল্য কামনা এবং বে-অব বেঙ্গল, ওপর ও নিচের মেকং অঞ্চলে এমনকি সুদূর দূরপ্রাচ্যে (এশিয়া প্যাসিফিকে) কীভাবে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বাদসাধা যায় তা তাদের মাথায় সব সময় রাখতেই হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ভূ-রাজনীতির ভায়রা ভাইদের বৈরিতার মধ্যেও বন্ধুত্বের বাণী এবং ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গের’ কূটকৌশল অবলম্বন করতেই হয়। ভারতীয় কূটনীতিতে তাদের দীক্ষা গুরু চাণক্য বা কৌটিল্যের ফতুয়া মাথায় থাকে। চাণক্য একটু সামান্য ট্যারা ছিলেন। চিত্রকররা কৌটিল্যের যে অবয়ব এঁকেছেন সেখানে তাকে কূটনৈতিক হাসিতে এবং একই সঙ্গে বিদ্রুপাত্মক রাজনৈতিক হাসিমাখা মুখ দেখা যায়। জোট নিরপেক্ষতার প্ল্যাটফরম মাড়িয়ে বিশ্ব মিত্রর যে দর্শন তা তো চাণক্যের পলিটির মুখ নিঃসৃত ভাষা। চীনের রাগ জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, চীনের ব্যবসায়ীদের অনুরাগ মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের রাগ চীনের সঙ্গে দৃশ্যত সীমান্ত বিরোধের কারণে হলেও তাদের সিল্ক রুটে ভারতের কাটা বা কটাক্ষ হাসি পরিষ্কার করার মহৎ (?) চিন্তাভাবনার ফসল। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের সীমানা রয়েছে মিয়ানমারের। ‘আসিয়ান’-এর দুর্বল সদস্য মিয়ানমারের জন্য মায়াকান্না জোড়া কার দরকার? মা’র চেয়ে মাসির দরদ বেশি যা এই মুহূর্তে চীনের মায়া যেমন মিয়ানমারের প্রতি।

চাণক্য ওরফে কৌটিল্য ঠাকুর যতই বিশ্বমানবতার স্বপক্ষে কথা বলেন, পাশের বা প্রতিবেশীর সঙ্গে আচরণে কখনো বড়ভাই, কখনো চিরশত্রুর সঙ্গে রাগ অভিমান দেখানোয় কার্পণ্য না করতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রতিবেশীর ঘরের কলা খাবার খাওয়ার বেলায় সম্পর্ককে অতি উচ্চে নেওয়ার বাহাস তার যেমন তার নিত্য প্রার্থনা থাকে প্রতিবেশীর শক্তি সামর্থ্য ও শান্তির বিরুদ্ধে সদা চঞ্চল থাকা।

মেকং অঞ্চলে ভারত তার ‘সহানুভূতি’ বা ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান ও সমীহের আশ্রয় নিয়েছে, ‘পিপল টু পিপল’ সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য। ব্যাংকক পোস্টের নিবন্ধকার মন্তব্য করেছেন, মেকং অঞ্চলের দেশগুলোতে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল গণতন্ত্রকে হরণ অর্থনৈতিক সমস্যার জালে জড়ানো জনগণকে শুধু ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে কতটা বাঁধা যাবে, তা দেখার বিষয়। খোদ ভারতের মধ্যে যখন স্বদেশি স্বগোত্রের মধ্যে রেষারেষি (ধর্মীয় কারণে বৈষম্য বিদ্যমান) সেখানে মেকং অঞ্চলে কীভাবে বিশ্বমিত্রতার মন্ত্র বাস্তবে রূপ নেবে? নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারত নিজ সংসারে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায় যারা ইন্দো চীনের বৌদ্ধদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি তাদের সঙ্গে বিরোধ ও বিড়ম্বনা তুঙ্গে তুলে যে মুঘল যুগে ভারতের স্থাপত্য শিল্প, আর্থিক প্রশাসন ও সামরিক বিদ্যা বিকাশ লাভ করেছিল সেই ৪ শতাধিক বছরের ইতিহাসকে মুছে ফেলার উদ্যোগ নিচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে স্ববিরোধী ভারত প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে তাতে মেকং অঞ্চলেও বিশেষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। নিবন্ধকার আরও স্পষ্ট করেছেন, ‘ভারত শুধু নিজ দেশের হিন্দু ও মেকং অঞ্চলের বৌদ্ধদের সমর্থন পেয়েও এবং যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে অগণতান্ত্রিক আচরণ করে বিশ্বের গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিনির্মাণে সক্ষম হবে? সে বিষয়ে সন্দিহান ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের জনগণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন শক্তি বা সরকারকে সমর্থন ও ভয় দেখায়। এসব দেশের জনগণ, গণতন্ত্রের জন্য জীবনপাতের সংগ্রামে, দুই মোড়লের মিশ্র মনোভাব দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠছে।’ প্রকৃত প্রস্তাবে নিকট প্রতিবেশী এবং মেকং অঞ্চলে (আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহ) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, চর্চা ও বিকাশে পরাশক্তিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিসংবাদ যতই থাকুক না কেন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অবশ্যই আরও পরিশীলিত নীতি কৌশলে ব্রতী হতে হবে এজন্য যে, এসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কিংবা ভবিষ্যতের গণতন্ত্র বিনির্মাণে সেটাই হবে কার্যকর সাফল্য যদি মানুষের গণতন্ত্র (মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যবিহীন ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সাফল্যকে সবার সাফল্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির অবয়ব হিসেবে পাওয়া) প্রতিষ্ঠা পায়। এখানে কূটকৌশলের দোলাচলে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার ভয় দেখিয়ে বা ভয় পাইয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে টেকসই সম্পর্ক উন্নয়ন করা যাবে না।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও কূটনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর