মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

স্বাস্থ্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত

আমরা জানি, স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না করলে স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত করে চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহায়কদের গুণগতমান উন্নয়ন স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব। ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে যথাসাধ্য অবদান রেখেছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবার শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারলেই এ খাতে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। বাংলাদেশে গত দুই দশকে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। যা মালদ্বীপে ৯.১৪%, ভারতে ১.১%, কিন্তু বাংলাদেশে ০.৪৭%। স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে সরকার জিডিপি ২% বরাদ্দ রাখলে ভালো হয়, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে মোট জিডিপির ৫%-এ উন্নীত করা। অবশ্যই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য। সরকারের কাছে এই ‘স্বাস্থ্য’ যদি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে অবশ্যই বাজেট বৃদ্ধি করা উচিত বলেই আমি মনে করি।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪০০ বিলিয়ন টাকা বাজেট বরাদ্দ করা হলেও তা অপ্রতুল। কারণ মূল বাজেট ৮ লাখ কোটি টাকা-এর ১০% এর থেকেও ৪০০ বিলিয়ন টাকা অনেক কম। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বাজেটে জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে ১০% বরাদ্দ রাখার দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। এমতাবস্থায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ছিল এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট এর পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা।

দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইকুইপমেন্ট দেখাশোনার জন্য বায়োমেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসা সেবা, মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার জন্য আলাদা অতিরিক্ত বাজেট দেওয়া প্রয়োজন। বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক-স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্তদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।

‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ কমিউনিটি ক্লিনিকের ধারণা জাতিসংঘের প্রশংসা অর্জন করেছে। ৭০টি দেশে এই কমিউনিটি ক্লিনিকের ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ৩০টি ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের এই স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহায়তা প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। হেলথ কার্ড এবং স্বাস্থ্যবিমা প্রবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে আরও উন্নত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অটোমেশনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। বাজেট বাড়ানো এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা করে এবং বাজেট সমন্বয়ের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। অর্থাভাবে ইমারজেন্সি সেবা দেওয়া না গেলেও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া প্রয়োজন। সীমিত বাজেট থাকা সত্ত্বেও, অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করে দক্ষতা বাড়িয়ে বাজেটের অর্থ সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব-এ ব্যাপারে সামগ্রিক কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আরও বেশি শক্তিশালী এবং গতিশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে সুদৃঢ়করণ করে বাংলাদেশেই যেন সব রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। সহজে যেন কেউ বিদেশে চিকিৎসা করার ব্যাপারে আগ্রহী না হয়, এ বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য কেউ যেন চিকিৎসা বঞ্চিত না হয় তার জন্য বিশেষ স্কিম চালু করা প্রয়োজন। এই বাজেটেই এ সম্পর্কে নতুন নির্দেশনা এলে ভালো হয়।

পাঁচবার নির্বাচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে এখন উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সমুদ্র বিজয়, মহাকাশ বিজয়, কর্ণফুলী টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের ফলাফল পুরো জাতির কাছে দৃশ্যমান। তবে মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে স্বাস্থ্য খাতে মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছরে উন্নীতকরণ। মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, MDG Award, Women Empowerment Award, South South Award-সহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার স্বাস্থ্য খাতে অর্জন করা গেছে, যা বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম সফলতা। কমিনিটি ক্লিনিক ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে সমাদৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি মেডিকেল স্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে দেশের সব রোগী দেশেই চিকিৎসা নিতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে লিভার, কিডনি, হৃদরোগ, ক্যান্সার, চক্ষু ও অন্য সব চিকিৎসা কম খরচে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে ভিশন সেন্টার চক্ষু চিকিৎসায় অবদান রাখছে। কম খরচে মৌলিক চাহিদা পূরণ ও অসংক্রমুখ রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পুষ্টি উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসূচক সমূহ ব্যাপক অগ্রগতি করা গেলে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের পূর্বশর্ত স্মার্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে হাসপাতালে কনসালট্যান্ট নিয়োগ, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত কনসালট্যান্ট নিয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নত করা প্রয়োজন। সুস্থ জাতি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার মূল চালিকাশক্তি। আগামী ২০২৪-২৫ বাজেটে মূল বাজেটের ১০% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। যা চিকিৎসাসেবায়, স্বাস্থ্য শিক্ষায় ও গবেষণা উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে উপজেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রদান করা সম্ভব হবে। দেশের অগ্রগতি উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর