শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মক্কাতুল মুকাররমার সম্মান ও আদব

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মক্কাতুল মুকাররমার সম্মান ও আদব

মুমিনের অন্তরে পবিত্র মক্কা নগরীর প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ, তা আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। কেয়ামত পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। যার ফলে এ নগরীর নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশেষণ। মহান আল্লাহতায়ালা এ ঘরকে নগরসমূহের মাতা বলে উল্লেখ করেছেন। আর এভাবে আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন নগরসমূহের মাতা মক্কা ও তার চতুর্দিকের লোকজনকে। সুরা শুরা : ৭। ত্বীন, যাইতুন, সিনাই পর্বত এবং এ নিরাপদ নগরীর শপথ। সুরা ত্বীন, শপথ এ নগরীর, আর আপনি এ নগরীর অধিকারী, সুরা বালাদ। নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তো বাক্কায় (মক্কায়) ইহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। সুরা আলে ইমরান। এ নগরীকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাই হিজরতের সময় মক্কা ত্যাগকালে তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, তুমি কতই না উত্তম নগরী এবং আমার কাছে কতই না প্রিয় নগরী, আমার সম্প্রদায় যদি আমাকে বের করে না দিত, তাহলে তোমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও আমি বসবাস করতাম না। বুখারি। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন- হে আমার পরওয়ারদিগার! একে তুমি নিরাপদ নগরী কর এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে ইমান আনে, তাদের ফলমূল থেকে জীবিকা দান কর। সুরা বাকারা। এ সেই নগরী, যেখানে মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁর বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত করে বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। জীবনের ৫৩ বছর এ নগরীতেই কাটিয়েছেন, এখানেই তিনি ওহি ও নবুওয়াত লাভ করেছেন। এখান থেকেই তিনি মিরাজে গমন করেছেন, আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবা শরিফ এ পবিত্র মক্কা নগরীতেই অবস্থিত। যাকে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের ঘর বলে অভিহিত করেছেন। তোমরা আমার পবিত্র ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর। সুরা বাকারা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কাবাকে সম্মানিত ঘর এবং মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করেছেন। সুরা মায়িদা। আমি আদিষ্ট সেই ঘরের প্রভুর ইবাদত করতে, যাকে তিনি হারাম (সম্মানিত) সাব্যস্ত করেছেন। সুরা নামল। নবীজি ইরশাদ করেন, আমার উম্মত ততদিন পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত তারা মক্কার যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করবে। যখন তারা এর অন্যথা করবে তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে, মিশকাত।

মক্কা শরিফ ও কাবা ঘরের সম্মান করা এবং অত্যন্ত বিনয় ও আদবের সঙ্গে সব আচার-আচরণ অবলম্বন করা প্রত্যেক মুসলমান মাত্রই কর্তব্য। তাই ইমাম বুখারি তার সহিহ গ্রন্থে ‘মক্কা প্রবেশের আগে গোসল’ শিরোনামে হাদিস বর্ণনা করেছেন। হজরত ইবনে ওমর (রা.) যখন মক্কা শরিফে আসতেন তখন যি-তুওয়া নামক স্থানে রাতযাপন করতেন। ভোরে গোসল করতেন এবং সেখানে ফজরের নামাজ আদায় করতেন, পরে মক্কা শরিফে প্রবেশ করতেন এবং এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করতেন যে নবী করিম (সা.) এরূপই করতেন। বুখারি, মুসলিম। হারাম সীমানায় শিকার করা, এমনকি শিকারিকে শিকারের ব্যাপারে পথপ্রদর্শন ও সাহায্য সহযোগিতা করাও যে হারাম, তা এই হারাম শরিফের সম্মানের কারণেই। আবহমানকাল থেকেই হারাম নিরাপদ ও সম্মানিত স্থান বলেই গণ্য হয়ে আসছে। যুদ্ধরত আরব গোত্রসমূহ সেই জাহিলিয়াতের যুগেও শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়ে হারাম সীমানায় বধ করত না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করত না। আর এই সম্মান কেয়ামতকাল পর্যন্ত থাকবে। নবীজি ইরশাদ করেন, কেয়ামত অবধি ইহা আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানের ভিত্তিতে সম্মানিত। সুতরাং হারাম এলাকায় কাঁটাযুক্ত গাছও কাটা যাবে না এবং তার শিকার জন্তুকে হাঁকানো যাবে না। বুখারি মুসলিম। কেননা আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন- যে হারাম শরিফে প্রবেশ করবে সে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ। কেননা হারাম শরিফে অবস্থানরত সবাই আল্লাহপাকের সম্মানিত মেহমান। চিরশত্রুকেও সেখানে কোনোরূপ অসদাচরণ করা যাবে না। কোনোরূপ আঘাত করা ও কষ্ট দেওয়া যাবে না। তাই হারাম শরিফে প্রবেশের আগেই উত্তমরূপে গোসল করে শরীর পাক, কাপড় পাক, মানসিক ও মানবিক পবিত্রতা অর্জন করে প্রবেশ করা সুন্নত। যখন মহাবরকতময় আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ শরিফ নজরে আসবে, তখন আল্লাহু আকবার এবং লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করবে। হজরত ইবনে ওমর ওই সময় বলতেন- বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। বাবুস সালাম দিয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করা উত্তম। নবী করিম (সা.) মসজিদুল হারামে বাইতুল্লাহ দর্শনকালে দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে এরূপ দোয়া করতেন। হে আল্লাহ এ ঘরের মানসম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধি করুন এবং যারা এ ঘরে হজ বা ওমরাহ করে, তাদেরও মানমর্যাদা, সম্ভ্রম বৃদ্ধি করুন। বাইতুল্লাহ শরিফ প্রথম দর্শনকালে দুই হাত তুলে যত দোয়া করা হয়, সমস্ত দোয়া আল্লাহপাক কবুল করে নেন। তাই পথ থেকে সরে, ভিড় থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে একিন ও বিশ্বাসের সঙ্গে মনপ্রাণ উজাড় করে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করা। অতঃপর কাবা চত্বরে সর্বপ্রথম তাওয়াফ করা, অতঃপর মাকামে ইব্রাহিমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, অতঃপর জমজম পানি পান করা। সর্বদা মনে রাখতে হবে, হজ বিনষ্টকারী তিনটি জিনিস থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখা। ১. সব রকমের অশ্লীলতা, এক্ষেত্রে বিশেষ করে পরনারী থেকে নিজের দৃষ্টিকে সংযত রাখা, ২. সব রকমের গুনার কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, ৩. পরস্পরের সব রকমের ঝগড়াঝাটি, গিবত, সমালোচনা, পরশ্রীকাতরতা, তোহমত ও অপবাদ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। মূলত এসব  গুনাহ হাজিদের মধ্যে বেশির ভাগ বিনা কারণেই ঘটে থাকে। কেননা আমাদের চরম শত্রু ইবলিশ শয়তান এসব নিষিদ্ধ কাজের প্রতি মানুষকে সর্বাত্মক উদ্বুদ্ধ করে থাকে। যেন তাদের হজ বিনষ্ট হয়ে খালি হাতে ফিরে যায়। আল্লাহপাক আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : ইমাম ও খতিব : কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর