মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ডাকাতিয়া একটি নদীর নাম

হোসেন আবদুল মান্নান

ডাকাতিয়া একটি নদীর নাম

আমাদের নদনদীগুলোর নাম কত সুন্দর, কত শ্রুতিমধুর, কী বৈচিত্র্যময়! মনে হয়, বাংলা ভাষায় নদনদী, পাখি আর ফুলের নামই সবচেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর এবং চিত্তাকর্ষক। নামে এরা অতুলনীয়-অদ্বিতীয়। তাই বিশ্বজুড়ে কবিদের কবিতা, গানে ও গীতিতে ঘুরে-ফিরে বারবার এদেরই নাম প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। যে দেশে নদনদীর নাম মধুমতী, কর্ণফুলী, যমুনা, নরসুন্দা, গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা, বিপাশা, কংস, মাতামুহুরী, কীর্তনখোলা, ময়ূরাক্ষী, ব্রহ্মপুত্র, সাঙ্গু ইত্যাদি। সেখানে ডাকাতিয়া নাম  নেহাতই বেমানান ও অনাকাক্সিক্ষত। তবু ডাকাতিয়া নামে একটি নদী আছে।

২. পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া তিন নদী এসে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। চাঁদপুর শহরের পাশেই নদীগুলোর এমন এক সংযোগ এবং সঙ্গমস্থল। শহরের মোল-হেড থেকে নদীগুলোর জলের পৃথক স্রোতধারা নজরে পড়ে। ২০০৪ সালে চাঁদপুর শহরের নতুন ও পুরান বাজারের মধ্যে ফেরি পারাপারের কাছাকাছি স্থানে স্থাপিত হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে আঁকা এক সড়কসেতু; যা পুরনো এ শহর এবং জনপদকে দিয়েছে অনন্য-অনুপম সৌন্দর্যের দৃশ্যমান রূপ-রূপান্তর।

২০০৬ সালে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের এডিসি হিসেবে যোগদান করি। তখনো সেতুটিকে প্রায় নতুন অবস্থায় দেখতে পাই। সেতুর মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চোখ রাখলে পদ্মা-মেঘনার বিপুল জলরাশির নিরন্তর বৈরী আচরণের বিচিত্র ভঙ্গিমা অবলোকন করা যায়। এমনকি দুই নদীর পানিতেও রয়েছে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। একটির জল ঘোলাটে অন্যটির অপেক্ষাকৃত কালো স্বচ্ছ। সেতুটি ডাকাতিয়ার মোহনার ওপর নির্মিত হলেও তিন নদীর জলে, তরঙ্গে, ঘূর্ণিপাকে একাকার হওয়ার প্রধান কেন্দ্রস্থল সেখানেই।

৩. ডাকাতিয়ার উৎপত্তিস্থল মূলত ভারতের ত্রিপুরায়। উৎসভূমি থেকে কুমিল্লা-লাকসাম হয়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার সংযোগে মিলিত হয়েছে। একে মেঘনার উপনদীও বলা হয়। ডাকাতিয়াকে দেখলে মনে হয় তার নিজের কোনো শক্তি নেই। যেখানে এসে সে মিশেছে এ দুই পরাশক্তিই তার নিজস্ব শক্তির আধার। সূর্যের আলোয় চন্দ্রের আলোকিত থাকার মতো। নদীটির দৈর্ঘ্য শুরুতে ২০০ কিমির কাছাকাছি থাকলেও দৈর্ঘ্যন্ডেপ্রস্থে আজকের অবস্থা সেভাবে দৃশ্যমান নয়। একেবারেই ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। জানা যায়, একসময় কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ইত্যাদি এলাকায় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল এ ডাকাতিয়া নদী। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের সিভিল সার্ভেন্টদের নানা রচনা ও স্মৃতিকথায় চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-কুমিল্লা যাতায়াতের বিচিত্র বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা মেঘনা, ডাকাতিয়া দিয়ে ধীরে ধীরে গোমতী অবধি পৌঁছে যেতেন। পরে কুমিল্লা থেকে তিতাস হয়ে ভাটি বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত সফর করেছেন। একসময় নদীটি ছিল উত্তাল, প্রমত্তা ও সর্বগ্রাসী। তখন প্রতি বছর বাংলার কৃষককুল এ নদীর সর্বনাশা প্রমত্তায় সর্বহারা হয়েছে। এমন জনশ্রুতি থেকেই এর ডাকাতিয়া নামের প্রচলন হয়েছে। তখনকার দিনে মানুষের নৈমিত্তিক যোগাযোগে নদীর বিকল্প ছিল কেবল নদী।

৪. চাঁদপুরে চাকরি করতে গিয়ে ডাকাতিয়ার তীরবর্তী ডান পাশের একটি রেস্ট হাউসে মোট ১৫ মাসের মতো ছিলাম। এটা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। তখন পর্যন্ত চাঁদপুরে মধ্যম সারির বা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আবাসন সমস্যা প্রকট ছিল। তারা সচরাচর সরকারি বাসা পেতেন না। কেউ সপরিবার বাস করতে চাইলে প্রাইভেট বাড়িই হতো ভরসা। বিশেষ করে জেলা প্রশাসনের এডিসি, জেলা জজশিপের অতিরিক্ত জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ডাকবাংলোয় মাসিক হারে ভাড়া পরিশোধ করে থাকেন। আমি নিজেও একটানা কয়েক মাস থেকেছি। পাশাপাশি কক্ষে জেলা প্রশাসন এবং বিচার বিভাগীয় অন্যান্য কর্মকর্তা থেকেছেন। এখন জেনে আনন্দিত বোধ করি, অতীতে এ বাংলোয় থেকেছেন তাঁদের কেউ কেউ পরবর্তীতে রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। পদাধিকারী হয়েছেন সরকারের সচিব, বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইত্যাদির।

ডাকাতিয়াকে বছরের প্রায় বারো মাসই বহতা দেখেছি। কখনো স্রোতস্বিনী, আবার কখনো সাময়িক স্থবিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছি। কখনো বা এক বুক ভাসমান কচুরিপানা নিয়ে ধীর লয়ে চলতে দেখেছি। তখন ডাকাতিয়াকে খুব বিষণ্ণ অসহায় দেখাত। তবে বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণতা পেয়ে ডাকাতিয়া খরস্রোতা হয়ে উঠত। পাড় উপচে গড়িয়ে পড়ত জল। তখনো নদীর বুকে মাছ ধরার কিছু জেলে অবশিষ্ট ছিল বলে মনে পড়ে। তবে শীত মৌসুমে বাংলোর কক্ষ থেকে পেছনের নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে ডাকাতিয়ার অস্বচ্ছ মলিন বদন দেখে হতাশ হতাম। মাঝেমধ্যে ভাবতাম, নদীটি কেন যে রাক্ষুসে মেঘনা আর পদ্মার মুখে এসে পতিত হলো! এমনটা না হলে ডাকাতিয়া হয়তো তার নামের প্রকৃত সার্থকতা বজায় রেখেই চলতে পারত। জন্মাবধি তাকে এভাবে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হতো না।

৫. ডাকাতিয়া নদীপারের বাংলোয় বসবাসের সময় সন্ধ্যায় একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদপুর শহরের নানা স্থানে হেঁটে বেড়াতাম। বিশেষ করে নতুন সেতুতে উঠে মুক্ত বাতাসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতাম, চাঁদপুর স্টেশন ক্লাব, টেনিস মাঠ, রেলস্টেশন, পুরান বাজার ইত্যাদি জায়গা বিনা কারণে ঘুরে দেখার অভ্যাস ছিল। তবে সেখানে প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন দিক্ভ্রমে পড়েছিলাম। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে ওঠে। শুক্রবারে জুমার নামাজে গিয়ে পূর্ব-পশ্চিম দিকটা বিশেষভাবে খেয়াল করে নিতাম। নতুন জায়গায় গিয়ে দিক চেনা আমার কাছে বরাবরই কৌতূহলী বিষয়। ডাকবাংলোয় কক্ষ বরাদ্দ প্রাপকদের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা করত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কজন। অর্থের বিনিময়ে তারা নিজ দায়িত্বে নির্ধারিত কক্ষে টিফিন বক্সে খাবার পৌঁছে দিত। খাবার পরিবেশনায় নিয়োজিত কর্মচারীদের নাম ছিল রহমান, নারায়ণ, গফুর এসব। আমরা মজা করে বলতাম, এদের যে নামেই ডাকুন মহান আল্লাহই খাবারের মালিক। ডাকাতিয়ার জলকে হাতের বাঁয়ে রেখে রমজানে বাংলোর দোতলার খোলা স্থানটিতে আমরা তারাবি নামাজ পড়েছি। সেদিনের সেই ইমাম সাহেব এখন হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি। আর মুসল্লি দুজনই অবসরপ্রাপ্ত সচিব।

৬. ডাকাতিয়াকে আশ্রয় করে এ নদীর দক্ষিণ পারে ব্রিটিশ আমল থেকেই ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। সেখানে রয়েছে জুট মিলস, লবণ  মিলস, চালের মিল ও কারখানা। চাঁদপুর পুরান বাজার থেকে ওপারের সঙ্গেই যোগাযোগব্যবস্থা বেশি সহজতর।

সেখানকার দুটি বড়ো আয়তনের জুট মিলসের মধ্যে ডব্লিউ রহমান এবং ইস্টার আল কায়েদ জুট মিল খুবই পরিচিত। এর অভ্যন্তরীণ ভূমির আয়তন হবে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ একর। একসময় এসব মিলের পাট চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ হয়ে যশোর-বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। আবার কুমিল্লা থেকে  লাকসাম, শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ হয়ে উত্তরাঞ্চলের সব কাঁচা পাট চাঁদপুরে নিয়ে আসা হতো।

রেলপথ শুরুর আগে এর অন্যতম প্রধান নৌপথ ছিল এ ডাকাতিয়া নদী। জানা যায়, নদীটি প্রায় শীর্ণকায় ও স্রোতহারা হয়ে পড়লে সরকার সাম্প্রতিক কালে ড্রেজিং করে একে সচল এবং নাব্য ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাই ডাকাতিয়ার ধূসর জলে যেন পুনরায় মেঘবতী আষাঢ়ের ছোঁয়া লেগেছে।

♦ লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর