মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আর মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, হেমায়েত উদ্দিন প্রমুখ কিছু মুক্তিযোদ্ধার মতো মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদের অবদান অমরতার অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে। কারণ তাঁরা শুধু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বই দেননি, গড়ে তুলেছিলেন মুক্ত এলাকা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাক্ষাৎ আতঙ্কে পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি ছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। সেনাবাহিনীর কোনো মেজর, কর্নেল কিংবা জেনারেল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন কর্নেল (পরে জেনারেল) আতাউল গণি ওসমানী। তাঁর মুখ্য পরিচয় একজন রাজনৈতিক নেতা। নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য। মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) আবদুর রবের পরিচয়ও অভিন্ন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে মুজিবনগর সরকার তথা প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের সমর্থনধন্য দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্ররাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অংশ নিয়েছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসারের কিছু সদস্য। যাদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন দেশপ্রেমের টানে। অন্য অংশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন আত্মরক্ষার তাগিদে। পাকিস্তানিরা নির্বিবাদে বাঙালি হত্যায় মেতে উঠেছিল একাত্তরে। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য ও পুলিশ-আনসার সদস্যদের ওপর বোধগম্য কারণেই তাদের নজরদারি ছিল বেশি। ফলে জীবন বাঁচাতে তাদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও দেশ ও জাতির প্রতি তাদের আনুগত্য সংশয়ের ঊর্ধ্বে ছিল না। মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে। অবসরজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ময়মনসিংহের ভালুকা থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক দল বা বেসামরিক নেতৃত্বে বেশ কিছু বাহিনী গড়ে ওঠে। যেমন টাঙ্গাইল ও সংলগ্ন এলাকায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী। বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালে হেমায়েত বাহিনী, দক্ষিণ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরের অংশবিশেষে সক্রিয় ছিল আফসার বাহিনী। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ এ বাহিনীর নেতৃত্বদানকালেই ‘মেজর’ পদবির অধিকারী হন। আফসার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে গেরিলা কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। বাহিনী গঠনে মেজর আফসার তাঁর সেনাজীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। তাঁর বাহিনী ছিল পাঁচটি ব্যাটালিয়নে বিভক্ত। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে ছিল পাঁচটি কোম্পানি এবং প্রতিটি কোম্পানিতে ছিল তিনটি প্লাটুন। প্রতি প্লাটুনে ছিল ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। আফসার উদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় দেশে অবস্থান করেছেন। অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় সূত্র থেকে। মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে তিনি রেখেছেন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ভারত থেকেও পেয়েছেন অস্ত্রের জোগান। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁর ব্যাপারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকর এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মনোভাব ছিল ইতিবাচক।
আফসার বাহিনী গঠনে সামরিক বাহিনীর কলাকৌশল ব্যবহার করা হলেও এটি ছিল পরিপূর্ণভাবে একটি জনবাহিনী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাধারী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হামলা চালিয়েছেন আফসার বাহিনীর কমান্ডোরা। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বিশালাকারের মুক্ত এলাকা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মুক্ত এলাকায় গড়ে তোলা হয় প্রশাসন। মেজর আফসার উদ্দিন মনে করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারাই স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়া উচিত। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন থানায় তাদের অস্ত্র জমা দেন। এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে ভাবতেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার সংরক্ষণে দেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ‘মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন তিনি। আমি ছিলাম খুলনা শাখার কমিটিতে। পরিষদের সভাপতি ছিলেন নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবদুল জলিল। মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের সূত্র ধরে মেজর আফসার উদ্দিন আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাসদের সঙ্গে যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং দেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তন কখনই মেনে নিতে পারেননি মেজর আফসার উদ্দিন। সেনাশাসনকে তিনি সেনাপতি শাসন বলার পক্ষপাতী ছিলেন। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাসদের একটি অংশ সেনাপতি প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের তলপিবাহকের ভূমিকা পালন করায় তিনি জাসদ ছেড়ে তাঁর পুরান সংগঠন আওয়ামী লীগে ফিরে যান। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ভালুকা উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন।মেজর আফসার উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গকে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, মু্িক্তযুদ্ধের শক্তির একটি মাত্র কেন্দ্র থাকা উচিত। আর সেটি হলো আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিভক্তি মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদেরই লাভবান করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত দল। কিন্তু জাসদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে বিভক্তি সৃষ্টি করে তাতে পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিই লাভবান হয়েছে। এমন স্বীকারোক্তিই তিনি দিয়েছেন সহযোদ্ধাদের কাছে। মেজর আফসার উদ্দিনের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি ছিলেন নিখাদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ যেমন অমরতার অনুষঙ্গ তেমন অমরতার অনুষঙ্গ মুক্তিযোদ্ধারাও। দেশের মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সফল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। অমরতার বরপুত্র মেজর আফসার উদ্দিনের পবিত্র স্মৃতির প্রতি অভিবাদন। সশস্ত্র সালাম।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক