শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন ব্যবস্থার কথা বলে গেছেন আব্বু

আইরীন মাহবুব

সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন ব্যবস্থার কথা বলে গেছেন আব্বু

আমার আব্বু মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার (২০১৭-২০২২)। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, কবি, আমলা, শিক্ষক এবং সাংবাদিক। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আব্বু হঠাৎ করে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। সাংবাদিক প্রয়াত মাহফুজউল্লাহ চাচা আব্বুর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। আব্বু কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। মহান আল্লাহ আব্বুকে যেমন হাত ধরে এই জায়গাটিতে এনে দেন, তেমনি একই সঙ্গে দেন ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার! ২০১৭ সালেই তাঁর ক্যান্সারের চতুর্থ স্টেজ ধরা পড়ে! কিন্তু মারণঘাতী এই রোগ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি! দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার ভয়াবহ রূপ দেখে মৌখিকভাবে এর প্রতিবাদ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতে তুলে নেন কলম! নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে নিরলসভাবে বই লিখতে শুরু করেন। নাম দেন ‘নির্বাচননামা’। এতে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। যেমন : ১. সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া উচিত, এবং তা তিন সদস্যবিশিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় ও তাদের বয়সসীমা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সার্চ কমিটির বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের প্রয়োজন নেই। ২. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ অবশ্যই বাতিল করতে হবে। ৩. নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি। সে জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, তাই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে। সে জন্য নির্বাচনে একটা লেভেল প্লেইং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা অত্যাবশ্যক। ৪. সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে! কিন্তু সেই ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগের জন্য জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। ৫. জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েন করা উচিত। ৬. জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার করা যেতে পারে। ৭. সরকারের পক্ষ থেকে বা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রেরণ করা প্রিসাইডিং অফিসারদের তালিকা গ্রহণ করা যাবে না। ৮. ইভিএমে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে অংশীজনের অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। সে জন্য ইভিএমে সতর্কতার সঙ্গে ভোটগ্রহণ করে ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ ইভিএমে ভোটগ্রহণ প্রশ্নবিদ্ধ হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। ৯. নির্বাচনে টাকার খেলা ও পেশিশক্তির প্রয়োগ রোধ করতে হবে। ১০. স্থানীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তিনি বিগত সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের জন্য একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘নির্বাচন এখন আইসিইউতে আর গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে’। যা বলার পর সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা পত্রিকায় বক্তব্য দেন, ‘মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য শালীনতাবহির্ভূত’; ইসিকে হেয় করতে নাকি তিনি সব কিছুই করেছেন!

এদিকে সরকারের ভিতরের কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক বলেছিলেন, কোনো কমিশনার এককভাবে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন না। এতে নাকি চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়! কমিশনারদের মধ্যকার মতভেদগুলো পাবলিক কেন জানবে! কিন্তু আব্বু মনে করতেন মতভেদ অবশ্যই সামনে আসতে হবে। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “আমি ‘সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের’ যে শপথ গ্রহণ করেছি, কলম হাতে নিয়ে আমি সেই কথাগুলো সর্বদা মস্তিষ্কে ও মননে ধারণ করেছি। সংবিধানের এই শব্দগুচ্ছ আমার কাছে জনগণের পবিত্র আমানত।”

কমিশনে আব্বুর কার্যকালে তিনি কয়েকবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে দেওয়া আব্বুর কিছু ভিন্নমত আমলে না নেওয়ার জন্য পরবর্তীতে আরও কিছু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আব্বু দিয়েছিলেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ দল থেকে আব্বুর পদত্যাগও দাবি করা হয়। ২০২২ এর জুলাইয়ের গোড়ায় আব্বু হঠাৎ বিছানায় পড়ে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন! দুটি হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস চিকিৎসা শেষে বাসায় নিয়ে আসা হয়। করোনার কারণে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা ব্যবস্থা বন্ধ থাকায়, আশা ছিল একটু ভালো হলে চেন্নাইতে নিয়ে যাব। মৃত্যুর মাত্র তিন দিন আগেও নিজ বেডরুমের হসপিটালের বেডে শুয়ে তিনি, প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান, বর্তমানে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ভাই প্রমুখকে ডেকে নিয়ে সন্তানসম বই ‘নির্বাচননামা’ প্রকাশের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন এবং আশা করেন, পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বইটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে! আব্বুর খুব ইচ্ছা ছিল, বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ বইটিকে কীভাবে গ্রহণ করে তা দেখবার। কিন্তু সেটা আর হয়নি! ২০২২ এর ২৪ আগস্ট তিনি অন্য এক জগতে পা বাড়ান! আব্বু যেন জানতেন, তাঁকে চলে যেতে হবে, তাই কি বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘এই বই আমার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি’? প্রচন্ড অসুস্থ হয়েও, প্রখর মনোবল নিয়ে বইটি লিখে গেছেন। আব্বু লিখেছেন, “ছদ্মগণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে জাতিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’’ তিনি আশঙ্কা করছিলেন, “গণতন্ত্রের লেবাসে এখন যে শাসন চলছে, তা পরবর্তী ধাপে স্বৈরতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করবে।” সেটাই কিন্তু পরবর্তীতে ঘটতে দেখা গেছে! “জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোর স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে দেশের নীরব জনগোষ্ঠীর অশ্রুত ভাষা শ্রবণের চেষ্টা” করেছেন তিনি।

তাঁর মতে, “উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না”। এই বইয়ের পাতায় পাতায় যেন আব্বুর দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে। বইয়ের মুখবন্ধে আব্বু লিখেছিলেন, ‘আমার মুখ বন্ধ নেই’। আসলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কখনো তিনি তাঁর মুখ বন্ধ করেননি। মুখবন্ধের শেষে বলে গেছেন, “মৃত্যুর পরেও আমার দুচোখ উন্মীলিত থাকবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। মানুষ নির্বাচনের সাঁকো বেয়ে গণতন্ত্রের আবাসভূমিতে যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারছে কিনা, সেটা দেখার জন্য। কেউ তখন আমার চোখের পাতা বন্ধ করে দেবেন না,  এই প্রত্যাশা পরিবার-পরিজনের কাছে।” আব্বু এমন এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি সুন্দর নির্বাচন হবে এবং মানুষ নির্ভয়ে নিজের ভোটটি নিজে দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন! গত জুলাই থেকে আগস্ট মাসে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশের নীরব জনগোষ্ঠী অধিকার রক্ষায় বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে!  অভূতপূর্ব সেই পট-পরির্বতনে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন করার আব্বুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। এই স্বাধীন দেশে আব্বুর স্বপ্ন নিশ্চয় একদিন বাস্তবায়িত হবে! আফসোস, তিনি এই পরিবর্তন দেখে যেতে পারলেন না! আজ আমার আব্বুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

♦ লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

সর্বশেষ খবর