মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার পতন রহস্য

আলম রায়হান

শেখ হাসিনার পতন রহস্য

সরকার আসে সরকার যায়- এটি সাধারণ বিষয়। আর স্বৈরাচারী হলে নানান অপকৌশলে মেয়াদ প্রলম্বিত করতে পারে। কিন্তু কোনো সরকারেরই মেয়াদ কেয়ামত পর্যন্ত অথবা অন্তকালের হয় না। এটি বিশ্বে বারবার প্রমাণিত সত্য, বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে। কাজেই এটি ধ্রুব সত্য ছিল, শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হবে। বিষয়টি ছিল কেবল সময়ের বিষয়। তবে এ সময়ের সীমা নিয়ে অনেকের মধ্যেই হতাশা ছিল। এখানে একটি মস্ত ভুল ছিল। যে ভুল আওয়ামী লীগ সরকারও করেছে, করেছে আমজনতাও। ক্ষমতাসীনরা কেবল শেন নজর রেখেছে বিএনপির দিকে। জনতাও ভরসা রাখতে চেয়েছে বিএনপির ওপর। কিন্তু বিএনপি কার্যকর কিছুই করতে পারছিল না। ফলে দেশের মানুষ হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যখন ধরে নিয়েছিল, ‘শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার নয়! ঠিক তখনই আবাবিল পাখির মতো ছাত্ররা, সঙ্গে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ মরণপণ লড়াইতে রাস্তায় নামল। ফলে আওয়ামী সরকারের পতন কেবল নয়, শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো! যা কেউ ভাবেওনি, তাই ঘটল। তবে এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটি শেখ হাসিনার অর্জিত পাপের ফল। প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা এ মহাপাপ অর্জন করলেন কীভাবে?

শেখ হাসিনা হয়তো সুলতান সুলেমান হতে চেয়েছিলেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অমলকান্তি যেমন হতে চেয়েছিল রোদ্দুর। একই কবিতায় বলা হয়েছে- ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।’ যা অমলকান্তির প্রত্যাশার বিপরীত। তেমনই শেখ হাসিনা সুলতান সুলেমান হতে পারেননি, হয়েছেন রোমানিয়ার চসেস্কু। যা বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। তবুও এটি বাস্তবতা। কারণ শেখ হাসিনা সুলতান সুলেমানের পথে হাঁটেননি, এগিয়েছেন চসেস্কুর পথে। জানা কথা, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শাসকদের একজন সুলতান সুলেমান। ইতিহাস বলে, সুলতান সুলেমান ছিলেন প্রজাবৎসল এবং ন্যায়পরায়ণ। ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ করেননি। কখনো আপস করেননি সততা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রশ্নে। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব প্রশ্নে একেবারে উল্টোপথের পথিক, উল্টো হাওয়ার পন্থি। দেশ শাসন করতে গিয়ে তিনি নিষ্ঠুরতা দমনপীড়নের পাঠ পুরোটাই নিয়েছেন। ফলে ক্ষমতা ত্যাগ করা কেবল নয়, দেশ থেকেও পালাতে হয়েছে তাকে। যাকে উড়ন্ত পলায়নও বলা চলে! কারণ তিনি হেলিকপ্টারে উড়ে পালিয়েছেন। ফলে কোনো বিচারেই তাকে সুলতান সুলেমানের সঙ্গে মেলানোর উপায় নেই। বরং অনেকটাই মেলানো যায় চসেস্কুর সঙ্গে। পতনের এক সপ্তাহের মধ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু ছাড়া আর সবকিছুই এখন পর্যন্ত হুবহু মিলে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সঙ্গে। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে রোমানিয়ার দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসক নিকোলাই চসেস্কুও হেলিকপ্টারে করে উড়ন্ত পলায়ন করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি ধরা পড়েছেন এবং ফায়ারিং স্কোয়াডে জীবন দিয়েছেন। তাদের দুজনের মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। শাসনামলে নিকোলাই চসেস্কু রোমানিয়ায় শ্রমশিবির, গুপ্তহত্যা ও প্রহসনমূলক বিচারে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। যে কারণে তাকে কার্পেথিয়ানের কসাই বলে অভিহিত করা হয়। চসেস্কু প্রকটভাবে একনায়ক শ্রেণিভুক্ত, তিনি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্টেট কাউন্সিলের সভাপতি ও একই সঙ্গে ১৯৭৪ সাল থেকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে রোমানীয় বিপ্লবে তার উৎখাত ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তিনিও শেখ হাসিনার মতো হেলিকপ্টারে পলায়ন করেছিলেন। তার শাসনামলে স্থিতিশীলতার মেয়াদ ছিল স্বল্প। তার সরকার দ্রুত একচ্ছত্রবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং সেই সময়ে পূর্ব ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়নকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তার গোপন পুলিশ বাহিনী, গণনজরদারির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে গুরুতর দমনপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির জন্য চসেস্কুর নীতিমালার কারণে দেশটিতে অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে অনাথ-এতিমের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭০-এর দশকে তেল উত্তোলনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় রোমানিয়া আকাশচুম্বী বৈদেশিক ঋণের জালে আটকে পড়ে। ১৯৮২ সালে চসেস্কু এ ঋণ পরিশোধের চেষ্টায় দেশের কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের বেশির ভাগ রপ্তানি করার নির্দেশ দেন। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখা দেয় এবং প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। গণচীন ও উত্তর কোরিয়া ভ্রমণের পর তিনি তার একক ব্যক্তিত্বের সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে বৈদেশিক সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গেও তার সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকে চসেস্কু রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন এবং ১৭ ডিসেম্বর সামরিক বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ফলে অনেক হতাহত হয়। এ ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা ও নাগরিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভ বুখারেস্ট পৌঁছানোর পর রোমানীয় বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করে। চসেস্কু ও তার স্ত্রী এলেনা একটি হেলিকপ্টারে রাজধানী থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী বেঁকে বসায় তারা সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন। বিচার এবং অর্থনৈতিক নাশকতা ও গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় উভয়কেই মৃত্যুদন্ডের সাজা প্রদান করা হয় এবং ১৯৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় পতনের এক সপ্তাহের মধ্যেই।

এদিকে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে পালানোর বিরল সুযোগ পেয়ে এখন পর্যন্ত ভারতের দিল্লিতে নিরাপদে আছেন। এ নিয়ে যেমন নানান প্রশ্ন আছে, তেমনই প্রশ্ন আছে তিনি না পালালে কী হতো। এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের জন্য তোলা থাক। আসা যাক আমজনতার চলমান প্রশ্নে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে কেন পালাতে হলো, তার পতনের রহস্য কী! জনরোষের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের ঘটনায় আবার প্রমাণিত হলো, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শাসন কাঠামো দাঁড় করিয়ে তাকে ইস্পাতকঠিন ভাবা হলেও তা আসলে পাটখড়ির চেয়ে বেশি কিছু নয়। এ কারণেই ১৯৯৬ সালের এক মেয়াদ এবং পরে টানা তিন মেয়াদ পেরিয়ে চতুর্থ দফায় সাত মাস অতিক্রম করে আর টিকতে পারেননি শেখ হাসিনা। যদিও তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। এ বাসনায় তিনি স্থাপন করেছেন নৃশংসতার চরম দৃষ্টান্ত। রোমানিয়ায় সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে, বাংলাদেশে চালিয়েছে পুলিশ এবং আওয়ামী বাহিনী। অবশ্য পুলিশের ইউনিফর্মের মধ্যেও দলীয় ক্যাডার ছিল বলে ধারণা অনেকেরই। লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছেন শেখ হাসিনা। যে পথে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানও হাঁটেননি। হয়তো শেখ হাসিনা জেনারেল টিক্কা খানকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। তবে এক্ষেত্রে তাকে অনুপ্রেরণা প্রদানকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানসম ব্যক্তি, শক্তি অথবা রাষ্ট্রটি হয়তো ইতিহাসে এক দিন নির্ধারিত হবে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতা নবায়নের কৌশল হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। অবশ্য একে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যাবে না। যদিও এ নির্বাচনের মাধ্যমেই শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় থাকার সাংবিধানিক অধিকার লাভ করেন। এ ধারায় তিনি নির্বাচনে ভোটের বাক্স প্রকারান্তরে সিলগালা করে দিয়েছিলেন। সবারই ধারণা হয়েছিল ব্যালটের মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায় হবে না; কিন্তু বিদায় হয়েছে, শিশু-কিশোর-যুবক-ছাত্র-জনতার রক্তের মূল্যে। যুগে যুগে অটোক্রেটিক শাসকরা প্রধানত দুটি কাজ করে। এক. সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন শক্তি কেন্দ্রকে তুষ্ট রাখা। দুই. জনগণের সামনে দৃশ্যমান কিছু করা এবং পেটে কিছু দেওয়া। শেখ হাসিনা ও চসেস্কু এমনটাই করেছেন। বুখারেস্টে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয়ের বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হওয়ার সেই দৃশ্য; আর সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যখন লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘সেনারা আমাদের সঙ্গে আছে।’ যে সেনাবাহিনী কয়েকদিন আগেও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, তারাই জনগণের পাশে দাঁড়াল। এদিকে হাসিনা সরকার চাইলেও বাংলাদেশের জনপ্রিয় সেনাবাহিনী জনতার ওপর গুলি চালায়নি। আর বাংলাদেশেও বাঁকবদলের মুহূর্তটি আসে, যখন সেনাবাহিনী এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, তারা প্রতিবাদী-বিক্ষোভকারীদের দমনে বলপ্রয়োগ করবে না। ফলে গুলি বিনিময়ের বদলে ফুল বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার সব ইকোয়েশন এলোমেলো হয়ে যায়। তার সাজানো সরকার কাঠামো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। অনেকেই মনে করেন, ছাত্র ও গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পেছনে একগুঁয়েমি, মজ্জাগত অহম ও অতি আত্মবিশ্বাসই প্রধান কারণ। একক কর্তৃত্বের শাসনে শেখ হাসিনার সরকার সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বকে শত্রু বানিয়ে শেষ পর্যায়ে ভূরাজনীতিতেও প্রায় একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার ঘটনা ঘটে। পদত্যাগের আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বোধগম্য কারণেই সেই সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। পদত্যাগ করে দুপুর আড়াইটার দিকে গণভবন থেকেই একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন। তার ছোট বোন শেখ রেহানা সঙ্গে ছিলেন। চসেস্কুর সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী। কী অদ্ভুত মিল!

চসেস্কুর মতোই দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। ১৪ দলেও ছিল অসন্তোষ। ফলে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দিক থেকেও একা হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পরও শেখ হাসিনা শক্ত অবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি পলায়নের আগের দিন ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়ে শক্তি প্রয়োগে আন্দোলন প্রতিরোধের চেষ্টা করিছিলেন শেখ হাসিনা। এতে কোনো ফায়দা হয়নি। বরং সারা দেশে সংঘাত-সংঘর্ষে ওইদিনই অন্তত ১০০ জন নিহত হয়। এরপরও শক্ত হাতে দমনের কথা বলা হচ্ছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন শেখ হাসিনা। পতনের সব আলামত অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়ার পরও সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গণভবনে সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। ক্রমাগত চাপ বাড়ার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু চাপ বাড়তেই থাকে। ফলশ্রুতিতে সবার কাছেই স্পষ্ট হয়, সময় শেষ। এরপর একগুঁয়েমি ত্যাগ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

স্মরণ করা যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকার সময়ও ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের অতি সাধারণ দাবি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি ‘রাজাকার’ শব্দও ব্যবহার করেছিলেন। এতে তার একগুঁয়েমি ও অহংকারের বিষয়টিই নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। সামগ্রিক অবস্থায় শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। আন্দোলন আরও জোরালো হয়। সেই আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করায় ১৭ জুলাই থেকে কয়েকদিনে সারা দেশে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকে, যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনী নামিয়ে কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন আরও জোরদার হয়। অন্তত ১ হাজার আদম সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিয়েও মসনদ রক্ষা করতে পারেননি শেখ হাসিনা। এজন্য অভ্যন্তরীণ বিষয় কেবল নয়, ভূরাজনীতিতে শেখ হাসিনার সরকারের ভারতনির্ভরতাও বিপদ ডেকে এনেছে। যদিও এ ভারতনির্ভরতার কারণেই পরপর তিনটি কলঙ্কিত নির্বাচনের তামাশা করেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক রেখে চলছিলেন তিনি। এ ছিল ব্যাঙ হয়ে সাপের মুখে চুমো দেওয়ার মতো বিষয়। কিন্তু এ কৌশলে কোনো ফল হয়নি। ফলোদয় না হওয়ার বিষয়টি অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে গত ৭ জুলাই শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্য দিয়ে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল অনেক দিন ধরেই। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাসহ তার নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে যায়। এ ধারায় চলতে চলতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হাসিনা সরকার। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ৫ আগস্ট পতন এবং পলায়ন। আওয়ামী লীগের নেতাদেরই কেউ কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে নিজের এতদিনের রাজনৈতিক অর্জন ধ্বংস করলেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকেও হুমকিতে ফেলেছেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্যরকম কথা বলেছেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত। এজন্য তাকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হয়েছে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর