শিরোনাম
রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা : বাংলা

আতাউর রহমান সায়েম, শিক্ষক, বাংলা

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা : বাংলা

[পূর্ব প্রকাশের পর]

‘Urdu and only urdu, shall be the state language of Pakistan.’অর্থাৎ ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে দামাল ছেলেরা তা মেনে নেয়নি। কারণ তাদের চেতনা কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতার খোকার মতো ছিল-

“মাগো ওরা বলে,

সবার কথা কেড়ে নেবে

তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।

বলো মা, তাই কি হয়?”

আর তাইতো তাদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ করেছে, মিছিল করেছে, সভা-সমাবেশ করেছে। আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ১৯৫২ সালে গঠন করেছে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। পাকিস্তানিরা ভয় পেয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে জারি করেছে ১৪৪ ধারা। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমেছে। ঐ দিন বেলা ৩টার দিকে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। তারপর গুলি চালাতে শুরু করেছে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। আহত হয়েছেন অনেক। সারা দেশের মানুষের তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর‌্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে।

শহীদ মিনার : ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করে। তারা আবাসিক হলের গেট দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হলে আকস্মিকভাবে তাদের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। এর ফলে বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক ছাত্র-যুবক মর্মন্তুদভাবে শহীদ হন। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতারাতি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ২৬ তারিখ বিকালে পুলিশ শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়। বিভিন্ন প্রতিক‚লতার মধ্যেও রাতে আবার শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। কেননা কবির ভাষায়-

“স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার?

ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো

চার কোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো। যে- ভিত কখনো কোনো রাজন্য

পারে নি ভাঙতে।”

- (স্মৃতিস্তম্ভ: আলাউদ্দিন আল আজাদ)

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন  ‘Mother Language lovers of the World’ -এর আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।  ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ তারা জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে সর্বপ্রথম একটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের যৌক্তিকতা এবং এই দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি প্রদান বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগ সমর্থন না পাওয়ায় তারা বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খুব দ্রুত ও সংক্রান্ত প্রস্তাব ইউনেস্কো (UNESCO) সম্মেলনে পাঠানো হয়। ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারি  ‘International Mother Language Day’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সূত্রেই একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

একুশের তাৎপর্য : একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু বাংলা ভাষাকেই স্বমর‌্যাদার প্রতিষ্ঠিত করেনি, তা বাঙালি জাতীয়তাকেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আর এর সূত্র ধরেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একুশে ফেব্রুয়ারি অর্জন করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর বিরল সম্মান। ’৫২- এর ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে অনেকের মতো কবি শামসুর রাহমান রচনা করেছেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি-

“তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার?

উনিশ শো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি

বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।”

আমাদের করণীয় : যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারির জš§ হলো এবং একুশে ফেব্রুয়ারির কারণেই যা কিছু জš§ দিলো তার সংস্কৃতির সামাজিক ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই। তার অধিকার যেন আমরা বিস্মৃত না হই। তবেই আমরা প্রতিপন্ন করতে পারব-  ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাঙালি-সংস্কৃতিরই একটি গৌরবময় অবদান। তাই আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবাসব, শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে ও লিখে লালন করব এবং তার প্রচার করব; কিন্তু সেটা উৎকট স্বদেশিকতা প্রদর্শন করে নয়, নিবেদিতপ্রাণ হয়ে মাতৃভাষার সেবা করার পাশাপাশি আমরা বিশ্বের সকল মানুষের ভাব মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাব। প্রতি বছরে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’কে একটি মহান দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করব।

আর আমরা সেই ভাষা শহীদদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব। কবিতার ভাষায়-

“একুশ ভাষার প্রাণ/ একুশ করেছে দান

একুশ মোদের পাথেয়/ একুশকে করো নাকো হেয়।”

উপসংহার : পৃথিবীর কোথাও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এত জীবনদানের ইতিহাস নেই। বাংলা ভাষাভাষীরা সে-ই অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এই সূত্রেই একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা ও উৎকর্ষের মাধ্যমে এ সম্মান সমুন্নত রাখতে হবে। আর আব্দুল গাফ্ফারের সে-ই প্রভাত ফেরির গানের সুরে সুরে আমাদেরও বলতে হবে-

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো

 একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি?”

সর্বশেষ খবর