রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
ভিসির কথা

উচ্চশিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস নয়

উচ্চশিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস নয়

  দেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যমান মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর মানোন্নয়নের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নে করণীয় কী, একে কীভাবে আরও কর্মমুখী এবং সময়োপযোগী করা যায়, বৈশ্বিক চাকরির বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রস্তুত হওয়া উচিত এসব নিয়ে কথা বলেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি— মহিউদ্দিন মোল্লা।

 

প্রশ্ন : দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

উপাচার্য : উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। গত দু’দশকে বাংলাদেশে শিক্ষার ব্যাপ্তি বেড়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে, তবে মানের প্রশ্নে হয়তবা কিছুটা পিছিয়ে আছে। বৃদ্ধি পেয়েছে পাসের হার। শিক্ষার হার বৃদ্ধি যেমন কাম্য তেমনি কাম্য মান বৃদ্ধি। আমাদের সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। শুধু পাসের হার ঊর্ধ্বগামী হলেই চলবে না একই সঙ্গে গুণগত মানের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই আপস করা যাবে না। 

প্রশ্ন : দেশে গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে প্রধান অন্তরায়গুলো কী কী?

উপাচার্য : এক সময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ দেখাত। বর্তমানে তেমনটা দেখা যায় না। এর অন্যতম কারণ বেতন ভাতা আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা। একজন ভালো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে সে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে না আছে ভালো শিক্ষার পরিবেশ, না আছে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক। শিক্ষক উন্নতমানের হলে তার ছাত্ররাও উন্নতমানের হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে শিক্ষককে শুধু ভালো হলেই হবে না তাকে তার শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হতে দেখা যায় না। একজন শিক্ষকের বড় চ্যালেঞ্জ তার ছাত্রদের আজীবন জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা। সেটি বাংলাদেশে কদাচিৎ হতে দেখা যায়। এক সময় সব স্কুল-কলেজে পাঠাগার ছিল, বর্তমানে এর বড় অভাব রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে উঠছে না।

প্রশ্ন : উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী ধরনের সংস্কার আনা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

উপাচার্য : বিশ্ববিদ্যালয় মানে যে বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যা চর্চা হয়। সে আলোকেই বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, গবেষণাটা এখানে গৌণ। গবেষণা যা হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পদোন্নয়নের জন্য। পদোন্নয়ন হয়ে গেলে তারপর শিক্ষকরা গবেষণা কর্মে মনোনিবেশ করার প্রতি তেমন একটা নজর দেন না। আর যেসব গবেষণা হয় তা মৌলিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ব্যতিক্রমও আছে। গবেষণার জন্য যে বাজেট বরাদ্দ থাকে তা অপ্রতুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান গবেষণাগুলো অত্যন্ত সেকেলে।

বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে যে কাজটি করতে হবে তা হলো বহির্বিশ্বের স্বনামধন্য গবেষকদের সঙ্গে বাংলাদেশের গবেষকদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একজন শিক্ষককে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে তার গবেষণাকর্মে অর্থায়ন অপরিহার্য। এটি করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে। একজন ভালো গবেষককে গবেষণাকর্মের জন্য উৎসাহিত করতে হলে তার জন্য চাই প্রণোদনা প্যাকেজ। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের সেরা গবেষকদের স্বীকৃতি দেওয়ার একটা ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এমন উদ্যোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ভালো পরিবেশ, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা না পেলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। এটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে। সরকার শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয় তার দুই ভাগের কম উচ্চশিক্ষার ভাগে পড়ে। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিনিয়োগ তা দ্বিগুণ করতে হবে। আর একটি বিষয় হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচি বা কারিকুলাম আরও বেশি যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় প্রণোদনা।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান্নোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে? বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উপাচার্য : কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করতে পারবে। আমি বিষয়টিকে ইউজিসির সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে মনে করি।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীরাও চাকরি লাভের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য চাহিদামাফিক যোগ্যতা নেই তাদের। এ থেকে উত্তরণে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় কি?

উপাচার্য : শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভালো মানুষ তৈরি করা, সার্টিফিকেট অর্জন নয়। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য ‘এ প্লাস’ নয়, শিক্ষার মানের ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত। আমি মনে করি শিক্ষা সবার জন্য কিন্তু উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। উচ্চশিক্ষা শুধু মেধাবীদের জন্য। অমেধাবী ও স্বল্প মেধাবীদের জন্য দরকার কর্মমুখী শিক্ষা। যে পদ্ধতি উন্নত বিশ্বে প্রচলিত। কর্মমুখী শিক্ষার একটা সুবিধা হলো সরকারকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হয় না বরং শিক্ষার্থীরাই নিজেদের কাজের ব্যবস্থা নিজেরাই করে থাকে। অর্থাৎ নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশের অভিভাবকদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে যেভাবেই হোক সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে হবে।

প্রশ্ন : গুণগত ও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে আপনার প্রতিষ্ঠান কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?

উপাচার্য :  বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, শিক্ষাসহায়ক আধুনিক সুবিধাদি বর্ধিত করা, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, ক্লাসরুম, ইন্টারনেটের সুবিধা রয়েছে। লাইব্রেরিতে প্রয়োজন সংখ্যক বইসহ ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। যোগ্য এবং মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা প্রদানের জন্য সিলেবাস আধুনিকায়ন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার সরবরাহ, রাসায়নিক দ্রব্যাদি সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ল্যাবরেটরি উন্নয়ন করা হচ্ছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরও সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

প্রশ্ন : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত?

উপাচার্য : বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

উপাচার্য : শিক্ষার্থীদের জন্য আমার পরামর্শ হলো— আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাঠগ্রহণের পাশাপাশি নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্যশীল সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলো। সুনাগরিক হয়ে পরিবার, সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের আত্মনিয়োগ কর।

সর্বশেষ খবর