মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

খরা কেটেছে ঢাকাই ছবির

আলাউদ্দীন মাজিদ

খরা কেটেছে ঢাকাই ছবির

ঢাকাই ছবি আবার দর্শক টানতে পারছে। অন্তত গত কয়েক বছরের চিত্র তাই বলে। সময় উপযোগী ছবি পেয়ে দর্শক আবার সিনেমা হলমুখী হচ্ছে। মানে খরা কেটেছে ঢাকাই ছবির। একাধারে নতুন অভিনয় শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজনা সংস্থা, গল্প, সিনেমা হল, সামাজিক গণমাধ্যম এবং আধুনিক প্রযুক্তি ঢাকাই ছবির এই সাফল্য বয়ে এনেছে।

নব্বই দশকের শেষভাগে এসে ঢাকাই ছবি অশ্লীলতার করালগ্রাসে পড়ে। এতে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের দর্শক ছিটকে পড়ে সিনেমা হল থেকে। ঢাকাই ছবির কথা শুনলেই নাক সিটকানো শুরু হয়। মাঝে মধ্যে দু-একটি ভালো ছবি নির্মাণ হলেও ঢাকাই ছবির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলায় দর্শক আর সিনেমা হলমুখী হতে চায়নি। এতে লোকসানের কবলে পড়ে এক হাজার ৫০০ সিনেমা হল। এখন কমে ঠেকেছে ২৮০- তে। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংস্কারের অভাবে পরিবেশ হারায় সিনেমা হল। সব মিলিয়ে ঢাকাই ছবির সোনালি দিন অতীত হয়ে যায়।

২০০৫ সালে ছোট পর্দার নির্মাতা সালাউদ্দীন লাভলুর হাত ধরে সব শ্রেণির দর্শক আবার সিনেমা হলমুখী হয়। ওই বছর তার ‘মোল্লাবাড়ীর বউ’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি দেখতে সিনেমা হলগুলো দর্শক পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। তারপর আবারও স্থবিরতা। ভালো ছবির আকাল। এই আকালে ২০০৯ সালে রঙিন সকাল বয়ে আনেন ছোট পর্দার আরেক গুণী নির্মাতা গিয়াসউদ্দীন সেলিম। ওই বছর মুক্তি পায় তার নির্মিত ‘মনপুরা’। ছবিটি দর্শক মন জয় করে টানা ছয় মাস চলে। দুটি ছবির নির্মাণ আঙ্গিক, গল্প বলার ঢং আর অভিনয়-গানে ছিল নতুনত্ব। এসবের সঙ্গে মডার্ন টেকনোলজির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নির্মাণে ফের বিপ্লব ঘটান বায়িং হাউস ব্যবসায়ী এম এ জলিল অনন্ত। ২০১০ সালে মুক্তি পায় তার প্রযোজিত ছবি ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’। এই ছবিটি দিয়েই এ দেশে ডিজিটাল পদ্ধতির ছবির সূচনা হয়। দর্শক আধুনিক পদ্ধতির নির্মাণ পেয়ে নড়েচড়ে বসে। ছবিটিতে নতুন মুখ হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন অনন্ত, বর্ষা, ববি, ইতালিয়ান অভিনেতা নিনো। আধুনিক পদ্ধতির নির্মাণ পেলেও আধুনিক মানে ডিজিটাল প্রদর্শন পেতে আরও দুটি বছর অপেক্ষা করতে হয় ঢাকাই ছবির দর্শকদের। ২০১২ সালে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটায় প্রযোজক আবদুল আজিজের জাজ মাল্টিমিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটি দেশের শতাধিক সিনেমা হলে ডিজিটাল প্রজেক্টর স্থাপন করে দর্শকের চোখে সময়ের স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। জাজ শুধু প্রজেক্টর স্থাপন করে দায়িত্ব শেষ করেনি। আধুনিক মানের ছবি হিসেবে ওই বছর ‘ভালোবাসার রঙ’ এবং একজোড়া নতুন মুখ বাপ্পী ও মাহিকে উপহার দেন। যারা কিনা প্রথম ছবিতেই জনপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। জাজ ডিজিটাল ছবি নির্মাণ, প্রদর্শন আর নতুন মুখ উপহার দিয়ে ২০১২ সালে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বর্তমান সময় পর্যন্ত নতুনত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। নুসরাত ফারিয়া, জলি, রোশন, পূজা চেরির মতো আরও অনেক সফল শিল্পী একই সঙ্গে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণের মাধ্যমে এ দেশের ছবিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দিয়েছে। এই পথে গত কয়েক বছর ধরে হেঁটে সফলতা পেয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড, অনন্য মামুন, রুবায়েত হোসেন, অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ, অনিমেষ আইচ, মেহের আফরোজ শাওন, স্বপন আহমেদ, শামীম আহমেদ রনি, বুলবুল বিশ্বাস, দীপঙ্কর দীপন, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল, এস এ হক অলিক, জাকির হোসেন রাজু, সৈকত নাসির, দেবাশীষ বিশ্বাসসহ অনেকে। জাজের পাশাপাশি লাইভ টেকনোলজি, হার্টবিট, জাহিদ হাসান অভির অভি কথাচিত্র, টাইগার মিডিয়া, শাপলা মিডিয়ার মতো অনেক প্রযোজনা সংস্থা ঢাকাই ছবির মান উন্নয়নে এগিয়ে আসে। ঢাকাই ছবি পেতে শুরু করে ‘আয়নাবাজি’, টেলিভিশন, শিকারি, বাদশা, পোড়ামন, রোমিও জুলিয়েট, নবাব, আশিকি, অগ্নি, বসগিরি, রাজনীতি, মেহেরজান, আন্ডার কনস্ট্রাকশন, ঢাকা অ্যাটাকের মতো দর্শকপ্রিয় সব ছবি। নুসরাত ফারিয়া, জলি, তানহা তাসনিয়া, রোশন, সাইমন, বাপ্পী, আরিফিন শুভ, তিশা, অরিন, অধরা খান, নাবিলা, মিলি, তানজিন তিশা, রাবিনা বৃষ্টি, বুবলী, পরীমণি, পিয়া বিপাশা, অহনা, শিরিন শিলা, অমৃতা খান, তানিয়া বৃষ্টি, মৌমিতা, আইরিন, নীলাঞ্জনা নীলা প্রিয়ন্তী পরীসহ অনেক দর্শকপ্রিয় শিল্পীতে ঢাকাই ছবি সমৃদ্ধ হয়। ছবি, নির্মাণ, গল্প, শিল্পী, নির্মাতায়, টেকনোলজিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে যখন ঢাকাই ছবি দর্শক টানতে শুরু করেছে তখন সিনেমা হল মালিকরাও তাদের সিনেমা হলগুলোকে সময়োপযোগী করে ঢেলে সাজাতে শুরু করে। ইতিমধ্যে মধুমিতা, বলাকাসহ অনেক সিনেমা হলের পরিবেশ আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গেছে। পরিবেশ হয়েছে উন্নত। ছবির নতুনত্বে ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ায় ঢাকার দিয়াবাড়ী আর সিরাজগঞ্জে গত ঈদে চালু হয়েছে দুটি সিনেপ্লেক্স। এ ধরনের আরও সিনেপ্লেক্স এখন সারা দেশে নির্মাণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ঢাকাই ছবির এই জয়যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এগুলোতে ছবির প্রচার এবং দর্শকের মতামতের তাত্ক্ষণিক প্রতিফলন ঘটতে পারায় দর্শক তাদের সুচিন্তিত মত দিতে পারছে। এতে একদিকে বিশাল দর্শক শ্রেণি যেমন ছবিটি সম্পর্কে দ্রুত জানতে পেরে সিনেমা হলমুখী হচ্ছে তেমনি নির্মাতারও নির্মাণে আন্তরিক ও যত্নবান হচ্ছে। খরা কাটছে ঢাকাই ছবির।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর