বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

যাদের হাতে বদলে যাচ্ছে চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

যাদের হাতে বদলে যাচ্ছে চলচ্চিত্র

২০০০ সালের শুরু থেকে ঢাকাই ছবির মন্দাবস্থায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। নতুন নির্মাতা কিংবা ছোট পর্দার নির্মাতারা এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বলে রাখা ভালো নব্বই দশকের শেষদিকে এসে ঢাকাই ছবি দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে। একশ্রেণির বিকৃত রুচির নির্মাতা আর শিল্পীর অসাধুতায় এদেশের ছবি তার সোনালি ঐতিহ্য ও কৌলিন্য হারায়। ঢাকাই ছবিতে শুরু হয় অশ্লীলতার জোয়ার। দেশি ছবি নিয়ে এই অচলাবস্থা দূর করতে প্রথমে এগিয়ে আসেন ছোট পর্দার অভিনেতা নির্মাতা সালাউদ্দীন লাভলু। ২০০৫ সালে তিনি নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘মোল্লা বাড়ির বউ’। অনেকদিন পর নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও দেশের মাটির গন্ধমাখা মৌলিক গল্পের ছবি পেয়ে সবশ্রেণির দর্শক সপরিবারে সিনেমা হলে ছুটতে থাকেন। পরের বছরই মানে ২০০৬ সালে ছোট পর্দার আরেক নির্মাতা এস এ হক অলিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নাম লেখান। তিনি নির্মাণ করেন ‘হৃদয়ের ব্যথা’। ছবিটি এবং এর সাফল্য দর্শকমনে আজও গেঁথে আছে। এর দুই বছর পর মানে ২০০৯ সালে ছোট পর্দার আরেক নির্মাতা গিয়াসউদ্দীন সেলিম সুনির্মাণের মাধ্যমে অনেকদিন পর ঢাকাই চলচ্চিত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটালেন। মুক্তি পেল এই নির্মাতার ‘মনপুরা’ ছবিটি। টানা ৬ মাস দর্শক বিপুল আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখেছে। এমন সাফল্যের ধারাবাহিকতা নতুনদের হাতে কিছুটা অনিয়মিত হলেও অব্যাহত থাকে। গত মাসে আবারও এই সাফল্যের প্রমাণ দিলেন চলচ্চিত্রে নতুন নির্মাতা দীপংকর দীপন। এই নির্মাতার ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিটি দেশ-বিদেশে দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে এখনো চলছে।

নতুন নির্মাতাদের হাতে এই সফলতার তালিকায় আগেই যুক্ত সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড ‘নাচোলের রানী’, ‘গঙ্গাযাত্রা’, ‘অন্তর্ধান’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘টেলিভিশন’, ‘ব্যাচেলর’সহ আরও কয়েকটি ছবি, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ‘প্রজাপতি’, ‘তারকাঁটা’, ‘সম্রাট’, অনিমেষ আইচ ‘জিরো ডিগ্রি’, ‘ভয়ংকর সুন্দর’, তৌকীর আহমেদ ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘রূপকথার গল্প’, ‘জয়যাত্রা’, গাজী রাকায়েত ‘মৃত্তিকা মায়া’, রিয়াজুল রিজু ‘বাপজানের বায়স্কোপ’, অমিতাভ রেজা ‘আয়নাবাজি’, শিহাব শাহীন ‘ছুঁয়ে দিলে মন’,  মেহের আফরোজ শাওন ‘কৃষ্ণপক্ষ’, আবু শাহেদ ইমন ‘জালালের গল্প’, রেদওয়ান রনি ‘চোরাবালি, আইসক্রিম’,   প্রসূন রহমান ‘সুতপার ঠিকানা’, সোহেল আরমান ‘এইতো প্রেম’, সামিয়া জামান ‘রানী কুঠির বাকি ইতিহাস’, ‘আকাশ কতো দূরে’, মুরাদ পারভেজ ‘চন্দ্রগ্রহণ, বৃহন্নলা’, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল ‘এক কাপ চা’, শাহীন কবির টুটুল ‘এই তো ভালোবাসা’, শাহনেওয়াজ কাকলী ‘উত্তরের সুর’, হাসিবুর রেজা কল্লোল ‘সত্তা’, শামীম আহমেদ রনি ‘মেন্টাল’, ‘ধ্যাততেরিকি’, ‘বসগিরি’ কলমের জাদুকরখ্যাত প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদও প্রথমে ছোট পর্দায় সফলতার আলো জ্বেলে পরে বড় পর্দা আলোকিত করেছেন। তার ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারি’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটু পুত্র কমলার’ মতো ছবিগুলোর অনবদ্যতা কখনো ভোলার নয়। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির বেশকিছু নির্মাতাও চলচ্চিত্র নির্মাণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- এনামুল করিম নির্ঝর ‘আহা’, জাহিদুর রহিম অঞ্জন ‘মেঘমল্লার’, ফাখরুল আরেফীন খান ‘ভুবন মাঝি’, বুলবুল বিশ্বাস ‘রাজনীতি’। নতুন নির্মাতাদের বেশির ভাগ নির্মাণই জাতীয়, আন্তর্জাতিকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমানে আরও যেসব ছোট পর্দার নাটক নির্মাতা বড় পর্দায় আলো জ্বালানোর কাজ নিয়ে এগিয়ে আসছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ও তাদের কাজ- তানিম রহমান অংশু ‘আদি’, ‘স্বপ্নবাড়ি’, রায়হান রাফি ‘পোড়ামন টু’, সাইফুল ইসলাম মান্নু ‘পুত্র’, মাহমুদ দিদার ‘বিউটি সার্কাস’, রাশেদ রাহা ‘নোলক’, মিজানুর রহমান আরিয়ান, আশুতোষ সুজন, মাবরুর রশীদ বান্না প্রমুখ। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিক্ষার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা খুব একটা ছিল না, বা এখনো তেমন গড়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে ছোট পর্দার নির্মাণের মাধ্যমে নির্মাতারা এ বিষয়ে বলতে গেলে সাধারণ ও কারিগরি জ্ঞান লাভ করে নিজেদের বড় পর্দার নির্মাণের জন্য প্রস্তুত এবং উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে পারছে। বড় পর্দার সফল নির্মাণের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক দিক। আমি চাই চলচ্চিত্রের পূর্ণতার জন্য এই ধারা অব্যাহত থাকুক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে  যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতাকে  দেখতে চায়। আয়নায় আপন চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা  সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর তখনই ছবিটি সফল হয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান।  আর এমন গল্পের ছবি বদলে দিচ্ছে দেশি চলচ্চিত্রকে, আর আজীবন এই বদলের ধারা অব্যাহত থাকবে। সম্প্রতি কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের নতুন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন  ছেপেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি  তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে তরুণ চলচ্চিত্রকারদেরও প্রশংসা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দিন বদলের হাতিয়ার এখন তাদেরই হাতে।

সর্বশেষ খবর