শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দলছুট এক গায়ক

পান্থ আফজাল

দলছুট এক গায়ক

চোখটা এত পোড়ায় কেন, ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও; সমুদ্র কি তোমার ছেলে, আদর দিয়ে চোখে মাখাও—কী অনবদ্য কথা ও গান! এমনই অনেক গানের জন্ম হয়েছে এক ক্ষণজন্মা সাংবাদিক-সংগীত শিল্পীর হাত দিয়েই। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাত্ক্ষণিক গান লেখার পর তাতে তখনই সুর বসিয়ে রাজপথ কাঁপাতেন স্বৈরাচার পতনের গানে গানে। তার রাজনৈতিক সচেতনতা ও কণ্ঠের মহিমা—এ দুইয়ে মিলে যেন আন্দোলনের ভাষায় কথা বলত সমন্বিত সুরে। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত থাকার পরও যিনি পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল। যিনি কখনো সমঝোতা করেননি নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে। তিনি আমাদের প্রিয় কাজলদা। যাকে সবাই গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী হিসেবেই চেনে। কয়েক দিন বাদেই এই ক্ষণজন্মা সাংবাদিক-সংগীত শিল্পীর জন্মতিথি। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে হবিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই একরোখা যুবক।

নব্বইয়ের শুরুর দিকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জম্পেস আড্ডায় সময় কাটাতেন প্রিয় তিনি। সেই দিনগুলোতেই তখনকার প্রখ্যাত গায়ক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বাপ্পা মজুমদারের। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ব্যান্ড সংস্কৃতি পেয়েছে ‘দলছুট’কে। বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে মিলে বের করলেন তার প্রথম অ্যালবাম ‘আহ্’। তার সুর ও গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে— ‘বায়স্কোপ’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকে বলে দিব’, ‘রিকশা’, ‘কথা বলব না’, ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস খেলে’, ‘চোখ’, ‘তখন ছিল ভীষণ অন্ধকার’, ‘আহ ইয়াসমিন’ প্রভৃতি। বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ এবং ‘কোন মেস্তরি বানাইয়াছে নাও’ গান দুটি কণ্ঠে তুলেও তিনি বেশ প্রশংসিত হন। ‘দলছুট’ গানের দল গড়ে সংগীতে শব্দ আর সুরের এক নতুন রুচির খোঁজ করছিলেন এই জাতশিল্পী। তার গাওয়া গান সবার মাঝে ব্যাপক সাড়া তুলেছিল সেই সময়ে। দলছুট থেকে বের হয়েছে একে একে ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজী’, ‘আকাশচুড়ি’, ‘জোছনাবিহার’। এর মধ্যে ‘স্বপ্নবাজী’ তার একক অ্যালবাম। সুরের ওপর সঞ্জীব চৌধুরীর দখল ছিল অসাধারণ। গানের মধ্যে কবিতাকে মিশ্রিত করে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কবি হিসেবেও একসময় পরিচিত ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। সম্ভবত তার কাব্যধর্মী গানগুলোই এই অভাব অনেকখানি পূরণ করেছিল। বেশ কিছু টেলিভিশন নাটকেও অংশ নিয়েছেন সঞ্জীবদা। বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছিলেন তিনি। সংগীত ও সাংবাদিকতায় তার প্রতিভা আর বেহিসাবী জীবন নিয়ে তিনি অল্প দিনেই প্রায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। ফিচার লিখেছেন, লিখিয়েছেন এবং তা সবাইকে শিখিয়েছেনও। গণমাধ্যমের কিছু গুণী সাংবাদিকের হাতেখড়ি হয়েছে সঞ্জীবের কাছে। দারুণ রোমান্টিক ছিলেন সঞ্জীবদা। তবে হিসেবী মানুষের ভিড়ে তিনি ছিলেন বেহিসেবী। অসম্ভব প্রাণচঞ্চল ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে কিছুটা মুখচোরাও। সংশয়, নির্লিপ্ততা আর অলসতা যেন তাকে জেঁকে বসেছিল বরাবরই। গানের জগতে আত্মপ্রকাশের আগ পর্যন্ত তার নাম তেমনটা প্রচার পায়নি। আত্মপরিচয়-বিমুখ মানুষটি চিরকাল সভা-সমাবেশ এড়িয়েই চলেছেন। অথচ আড্ডায় তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি, দু’হাতে আগুন তারও; কার মালা থেকে খসে পড়া ফুল, রক্তের চেয়ে গাঢ়?’— প্রেমের সঙ্গে বিপ্লবের মেলবন্ধন সমরেশের কালবেলায় ঘটে, ঘটে সঞ্জীবের গানে। ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়স্কোপ, বায়স্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না’। কিন্তু শেষাবধি সব নেশা ছেড়ে চলেই গেলেন তিনি। সঞ্জীবদার শারীরিক উপস্থিতি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি সদা চলমান, সদা প্রাসঙ্গিক। যার সৃষ্টিশীলতার গাড়ি যেন চলছেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর