বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

শ্রীদেবীর মৃত্যু রহস্য

শ্রীদেবীর মৃত্যু রহস্য

দুবাইয়ে একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে শনিবার রাতে আচমকা মৃত্যু হয় বলিউডের চাঁদনীর। জুমেইরা এমিরেটস টাওয়ার হোটেলের শৌচাগারের বাথটবে ৫৪ বছরের শ্রীর হার্ট অ্যাটাক হয় বলে জানান তাঁর দেবর অভিনেতা সঞ্জয় কাপুর। এরপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। এদিকে  শ্রীদেবীর মৃত্যু ঘিরে একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠে আসার পরই তদন্ত আরও জোরালোভাবে শুরু করার নির্দেশ দেয় পুলিশ। একইসঙ্গে শ্রীদেবীর হোটেলের ঘর সিল করে দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব

 

ফরেনসিক রিপোর্ট পাল্টে দিল হৃদরোগ

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকাল প্রয়াণ ঘটেছে শ্রীদেবীর। শুরু থেকে এমনটিই জানা গিয়েছিল। ফরেনসিক রিপোর্ট আসার পর ছবিটা পালটে গেল। রিপোর্টে বলছে, জলে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে অভিনেত্রীর। তাঁর রক্তে অ্যালকোহলের নমুনা পাওয়া গেছে। জ্ঞান হারিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরেই বাথটবে পড়ে যান তিনি। আর সেই পানিতে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। ফলে নতুন করে তৈরি হলো নানা প্রশ্ন।

 

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

 ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, রিপোর্টে যা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে কোথাও বলা হয়নি, শ্রীদেবীর শরীরে বাইরে থেকে কোনো আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা ছিল। তাই খুন বলা যাচ্ছে না।  কোনো ভারী জিনিস দেহে চাপিয়ে শ্রীদেবী বাথটাবে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন, এমন প্রমাণও পাননি দুবাইয়ের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।

 

দুর্ঘটনা নাকি খুন?

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, শ্রীদেবীর রক্তে যদি অ্যালকোহল পাওয়া গিয়ে থাকে তবে তার পরিমাণ কত?  কোনো ব্যক্তির শরীরে যদি ‘২০০ মিলিগ্রাম শতাংশ’ অ্যালকোহল থাকে তাহলে তাঁর পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাহলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে  যেতেই পারেন। এক্ষেত্রে  শ্রীদেবী কীভাবে বাথটাবে পড়েছিলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে এবং তা ভেঙে শ্রীদেবীকে উদ্ধারের চেষ্টা হয়, তাহলে এই মৃত্যু সত্যিই ‘অ্যাক্সিডেন্টাল’। যাবতীয় জল্পনার অবসান হতে পারে এখানেই। নইলে কিন্তু খুনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে ধরে নিয়ে তদন্ত হবে।

বনিকে সন্দেহ

 দুবাইয়ের সংবাদপত্র ‘খালিজ টাইমস’ প্রথমে জানিয়েছিল, বনি সেই সময়  হোটেলে শ্রীদেবীর ঘরে ছিলেন। শনিবার স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ তিনি মুম্বাই থেকে দুবাই পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি শ্রীদেবীর হোটেলেই পৌঁছেছিলেন তিনি। একটা সূত্র বলছে, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রুম সার্ভিসে ফোন করে তাঁর ঘরে পানি দিতে বলেছিলেন শ্রীদেবী। মিনিট ১৫ পর হোটেলের এক কর্মী শ্রীদেবীর ঘরে পানি দিতে গিয়ে তাঁর কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না। হোটেল কর্তৃপক্ষ দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে শ্রীদেবীকে বাথটাবে অচৈতন্য পান। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তা হলে বনি সেই সময় কোথায় ছিলেন?

 সোমবার দ্বিতীয় দফা বনি কাপুরের সঙ্গে কথা বলে দুবাই পুলিশ। তদন্তভার দেওয়া হয়েছে দুবাইয়ের পাবলিক প্রসিকিউশনের ওপর।

 

অমর সিংয়ের দাবি

বিজেপি নেতা অমর সিংয়ের দাবি, শ্রীদেবী মদ্যপান করতেন না। অনুষ্ঠান ইত্যাদির ক্ষেত্রে ওয়াইন খেতেন। তার এই দাবিতে ধোঁয়াশা আরও বেড়েছে। তাহলে অভিনেত্রীকে জোর করে কেউ মদ্যপান করিয়েছিলেন। ফরেনসিক রিপোর্ট প্রকাশ ও অমর সিংয়ের দাবিকে ঘিরে নতুন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।

 

শ্রীদেবী কি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন?

ভাগ্নের বিয়ের পর মেয়ে খুশিকে নিয়ে মুম্বাই ফিরে এসেছিলেন বনি কাপুর। দুবাই ফিরে যান দুই দিন পর। ওই দুই দিন  হোটেলেই ছিলেন শ্রীদেবী একা। তাঁকে এক বারের জন্যও ঘরের বাইরে দেখা যায়নি। কেন? অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তবে কি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন অভিনেত্রী?

পুলিশের সন্দেহ

শ্রীদেবীর ডেথ সার্টিফিকেট হাতে আসার পর দুবাই পুলিশ গোটা ঘটনাটাই সরকারি  কৌঁসুলির হাতে সমর্পণ করেছে। সিল করে দিয়েছে শ্রীদেবীর সেই ঘর। নানা প্রশ্নের উত্তর দুবাই পুলিশও খুঁজছে। তা হলে কি শ্রীদেবীর এই মৃত্যুর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য?

 

দাম্পত্য কলহ

শ্রীদেবীর বিবাহিত জীবন কখনই সুখের হয়নি। দুবারই তাঁর বিয়ে করা পুরুষরা আগে থেকেই বিবাহিত। তবে কি শ্রীদেবীকে নিয়ে বনির পরিবারে গত ২৫ বছর যে অশান্তির চোরাস্রোত বয়ে চলছিল, তা থেকেই ধীরে ধীরে হতাশার অন্ধকারে ঠেলেছে শ্রীদেবীকে। তবে কি দাম্পত্য কলহ চলছিল? তা না হলে শ্রীদেবীকে একা দুবাইয়ে ফেলে আসার আর কী কারণ থাকতে পারে?

 

সার্জারি মৃত্যুর কারণ?

শ্রীদেবীর ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্রের দাবি, শ্রীদেবীকে হাতের পুতুল মনে করতেন বনি। কামব্যাক পর্বে শরীর ফিট রাখতে, সার্জারিতে বাধ্য করতেন বনি। ‘মম’ ছবির আগেও তাঁর লিপ সার্জারি করিয়েছিলেন বনি কাপুর। এ ব্যাপারে শ্রীদেবীর ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা জানতে চাইতেন না বনি। মনে করতেন তিনি যা করছেন তা শ্রীর ভালোর জন্যই। ৫৪ বছরের জীবনে ২৯ বার সার্জারি করেছেন শ্রীদেবী। সর্বশেষ সম্প্রতি ঠোঁট মোটা করার জন্য সার্জারি করেন। তাহলে কি একজন অতি পেশাদার প্রযোজক প্রকৃত ভালোবাসার মানুষ হতে পারেননি? গুড হাউস ওয়াইফের আড়ালে ব্যথা লুকিয়ে ছিল সুন্দরী সুপারস্টারের?

 

তিন ঘণ্টার হিসাব

রিপোর্ট বলছে বিকাল সাড়ে ৫টায় শ্রীকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে আসেন বনি। দুবাইয়ের যে হোটেলে শ্রী ছিলেন, তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বনির এন্ট্রি। এরপর দুজনের কাউকেই ঘর থেকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখা যায়নি। বনি কাপুরের কাছ থেকে জুমেইরা টাওয়ারের কর্মীরা ডাক পান সাড়ে ৭টা নাগাদ। এরপর ঠিক রাত ৯টায় খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। তারপর শ্রীদেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় রশিদ হাসপাতালে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে কেন এই দেরি? এই তিন ঘণ্টায় কী ঘটেছিল তাদের হোটেল কক্ষে।

 

বনির জবাবে অসঙ্গতি

দেরি প্রসঙ্গে বনি কাপুরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি শ্রীদেবীর ঘরে যখন ঢোকেন তখন শ্রী ঘুমোচ্ছিলেন। বনি তাঁকে জাগান। তার পরের ১৫ মিনিট দুজনে গল্প করেন। তারপর শ্রীকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি হয়েই শ্রী তৈরি হওয়ার জন্য স্নান করতে যান। ১৫ মিনিট পরও স্নানঘর থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে সন্দেহ হয় বনির। বাথরুমের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন। শ্রীদেবী তখন অচৈতন্য অবস্থায় বাথরুমে পড়ে ছিলেন। বনি তাঁর সংজ্ঞা ফেরানোর চেষ্টা করেন। খবর দেন হোটেল কর্মীদের। তাঁরাই চিকিৎসক ও পুলিশকে খবর দেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে বাকি সময়টুকু কী করছিলেন বনি? তাঁর দেওয়া হিসাব মেলালে ঘরে ঢোকার ৪০ মিনিটের মধ্যেই তিনি দরজা ভেঙে শ্রীকে উদ্ধার করেন। সিসিটিভির রিপোর্ট অনুযায়ী সেসময় ৬.১০ বাজার কথা। তারপরও কর্মীদের খবর দিতে কেন প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিলেন বনি কাপুর?

 

তসলিমার টুইটে নয়া বিতর্ক

এদিকে শ্রীদেবীর মৃত্যু নিয়ে সংশয়ী প্রশ্ন তুললেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। নতুন করে ছড়াল বিতর্কের আঁচ। টুইটে তসলিমা লেখেন, একজন সুস্থ মহিলা কখনো এভাবে ‘দুর্ঘটনাবশত’ বাথটবে পড়ে যেতে পারেন না। প্রাপ্তবয়স্করা কখনো ‘দুর্ঘটনাবশত’ বাথটবে পড়তে পারেন না। শ্রীদেবীর দেহ পানি ভর্তি বাথটবে পাওয়া গেছে। আশা করি এটা হত্যা বা আত্মহত্যা নয়।

 

সুব্রহ্মণ্যমের দাবি খুন

বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দাবি করেছেন শ্রীদেবীকে খুন করা হয়েছে। কারণ এই অভিনেত্রীর সঙ্গে আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আর এই সম্পর্ক নিয়ে বনির সঙ্গে শ্রীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। আর এতেই সুযোগ বুঝে খুন করা হয়েছে এই অভিনেত্রীকে। তবে খুন কে করেছে বা কার নির্দেশে হয়েছে সে সম্পর্কে খোলসা করে কিছু বলেননি এই বিজেপি নেতা।

 

দাউদ ইব্রাহিম নাটের গুরু?

তাহলে কী আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের পরিণামে শ্রীদেবীকে এভাবে জীবন দিতে হলো। বিষয়টি বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যমের মুখ থেকে প্রকাশ হলেও এর সত্য মিথ্যা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তারপরেও শোবিজ দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে এর আগেও এই মাফিয়া ডনের সম্পর্ক এবং পরিণতিতে খুন বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশও নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে।

 

আবার ময়নাতদন্ত হবে

ভারতীয় প্রশাসন এখন দুবাইয়ের কাছ থেকে শ্রীদেবীর ফোন কললিস্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, ময়নাতদন্তের রিপোর্টসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে। নানা কারণে ভারতীয় প্রশাসনের মনেও বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে ভারত পুনরায় শ্রীদেবীর ময়নাতদন্ত করতে পারে বলে জানা গেছে।

 

বনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ভারত

শ্রীদেবীর স্বামী বনি কাপুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ভারত। শুধু তাকে নয়, তার পরিবারের সদস্য এবং দুবাই হোটেলের কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবার জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানিয়েছে ভারতীয় প্রশাসন। সবমিলিয়ে ধরেই নেওয়া যাচ্ছে শ্রীদেবীর মৃত্যুকে এখন কেবল দুর্ঘটনা নয়, হত্যা হিসেবেও সন্দেহ করছে দুবাই এবং ভারত।

 

বিলম্বিত হতে পারে শ্রীদেবীর সৎকার

মৃত্যু রহস্য বাড়তে থাকায় শ্রীদেবীর সৎকার বিলম্বিত হতে পারে। এমন ইঙ্গিত দিয়েছে দুই দেশের প্রশাসন। কারণ এই মৃত্যু এখন রহস্যে পরিণত হওয়ায় এর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সৎকারের প্রশ্নই আসে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর