শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
চরম লোকসানে প্রদর্শকরা

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব সিনেমা হল

মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাবে দর্শক খরায় চরম লোকসান চলছে সিনেমা হলগুলোতে। এ অবস্থায় কলকাতার ছবি আমদানি করে সিনেমা হল চালু রাখার উদ্যোগ নেয় চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছেন কতিপয় চলচ্চিত্রকার। ফলে ছবির অভাবে বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল হয়ে পড়েছে যে, সব সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন প্রদর্শকরা।

আলাউদ্দীন মাজিদ

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব সিনেমা হল

ছবির অভাবে লোকসান গুনে খেলা দেখিয়েও টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না জোনাকী সিনেমা হল

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ছবি নেই। মাঝে-মধ্যে যেসব ছবি মুক্তি পায় মানসম্মত না হওয়ায় দর্শক তা দেখে না। এ অবস্থায় চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন প্রদর্শকরা। সিনেমা হল মালিকরা বলছেন, এ অবস্থায় তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তারা জানান, যে কোনো দিন থেকে সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়া হবে।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাশ বলেন, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত দেশীয় ছবির অভাবে বাধ্য হয়ে কলকাতার বাংলা ছবি সাফটা চুক্তির আওতায় আমদানি করা হয়, যাতে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু এফডিসিভিত্তিক কিছু বেকার প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী যারা নিজেরা ছবি নির্মাণ করেন না আবার কলকাতার ছবি সরকারি আইন মেনে আমদানি করতে গেলে অযৌক্তিকভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। এতে ছবির অভাবে সিনেমা হল মালিকরা লোকসান গুনে দৈন্যদশায় পতিত হয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির ওপর ক্রমাগত এর সুরাহার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। তাই প্রদর্শক সমিতি ৩ এপ্রিল চলচ্চিত্র দিবস পালন শেষে সন্ধ্যায় সভা করে তাতে সিনেমা হল বন্ধের চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে পারে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কলকাতার ছবি আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয়েরও অসহযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো শাকিব-শুভশ্রী অভিনীত কলকাতার ছবি ‘চালবাজ’। ছবিটি রপ্তানির বিপরীতে আমদানির জন্য চলচ্চিত্র প্রযোজক কামাল কিবরিয়া লিপু তার এন ইউ আহমেদ ট্রেডার্সের মাধ্যমে আবেদন করেন এবং ছবিটি আমদানির জন্য ইতিমধ্যে ‘নিজের অজান্তে’ শিরোনামে একটি ঢাকার ছবি কলকাতায় রপ্তানি করেন। চালবাজ আমদানির জন্য গত ৮ মার্চ তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। ওই দিন কলকাতা থেকে ছবির প্রযোজক অশোক ধানুকা ঢাকায় এসে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে মন্ত্রী চালবাজ এ দেশে প্রদর্শনের জন্য অশোক ধানুকাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেই হিসেবে ৬ এপ্রিল ছবিটি মুক্তি দিতে প্রাথমিক প্রস্তুতি নেন আমদানিকারক। কিন্তু মন্ত্রীর উদ্যোগ সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে  দীর্ঘ সময় পার করে ২১ মার্চ অতিরিক্ত তথ্য সচিব ছবির আমদানি-রপ্তানি কমিটির সদস্যদের বৈঠকে ডাকে। ওই দিন বেলা ১১টায় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও সচিব আসেন বেলা আড়াইটায়। তিনি এসে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়েই তাড়াহুড়া করে বৈঠক শেষ করেন বলে আমদানি-রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করেন। ফলে ৬ এপ্রিল ছবিটির মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়লে সিনেমা হল মালিকরা প্রদর্শক সমিতির ওপর ছবিটি যথাসময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করতে ফের চাপ দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রদর্শক সমিতি নির্বাহী কমিটির বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় কর্মকর্তারা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ছবিটি দ্রুত আমদানির অনুরোধ জানাবেন। ওই দিন রাতে তারা ওই ছবির নায়ক শাকিব খানের সঙ্গেও জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকেও সাফটা চুক্তির অধীনে রপ্তানির বিপরীতে আমদানির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৭ মার্চ প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ, প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাশ, উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন প্রমুখ তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে মন্ত্রী দৃঢ়প্রত্যয়ে ঘোষণা করেন কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের ছবি আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বাধা সহ্য করা হবে না।

তিনি চালবাজ ছবিটি দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্টকে নির্দেশ দেন। বৈঠকে মন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক রয়েছে। দুই বাংলায় ছবি আমদানি-রপ্তানিতে বাধা থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না।  বৈঠকে মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের শিল্পী শাকিব খান আর জয়া আহসান কলকাতার ছবিতে অভিনয় করে দেশের জন্য প্রশংসা ও পুরস্কার কুড়াচ্ছেন। এটি আমাদের দেশের জন্য সত্যিই গর্বের বিষয়। তাই এক্ষেত্রে উৎসাহ আর সহযোগিতা থাকা উচিত। ওই দিন বিকালেই আমদানি-রপ্তানিকারকদের নিয়ে সচিব জরুরি বৈঠক করে ছবিটি আমদানির জন্য পদক্ষেপের কথা জানালেও পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে মন্ত্রণালয় থেকে আমদানিকারককে এপ্রিল মাসে ছবিটি মুক্তি না দিতে বলা হয়। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এন ইউ আহমেদ ট্রেডার্সের পক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ করে জানানো হয়, এখন ঈদ ছাড়া ‘চালবাজ’ মুক্তি দেওয়া আর সম্ভব নয়। কারণ মে মাসে রমজান থাকায় তখন ছবিটি মুক্তি দেওয়া যাবে না। আর রমজানে শাকিবের আরেকটি ছবি ‘ভাইজান এলো রে’ মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। একই সময়ে এক নায়কের একাধিক ছবি মুক্তি পেলে কোনো ছবিই ভালো ব্যবসা না করার সম্ভাবনা থাকবে। এ অবস্থায় প্রদর্শক সমিতির কয়েকজন কর্মকর্তা এবং বেশকজন সিনেমা হল মালিক জানান, ১৩ এপ্রিল থেকে সিনেমা হল বন্ধের কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। কারণ ভালো ছবি প্রদর্শনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বার বার আমাদের লোকসানের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রদর্শক সমিতির আরেক উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ভালো ছবির অভাবে সিনেমা হল চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সিনেমা হল না থাকলে চলচ্চিত্র শিল্প বলে কিছু থাকবে না। আমরা চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু নানা অযৌক্তিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এবার হার্ডলাইনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই। প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের উদ্যোগ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠা ষড়যন্ত্রকারীরা এখন সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদকে বিএনপিপন্থি বলে সরকারের কাছে অপপ্রচার চালাচ্ছে। যা সত্যিই দুঃখজনক। পাশাপাশি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে দেশের শীর্ষ প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া বন্ধের ঘোষণায় উদ্বেগ জানান সিনেমা হল মালিকরা। তাদের কথায়, এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে বেশির ভাগ ভালো মানের ছবি উপহার দিয়ে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছে।

এদিকে ‘চালবাজ’ ছবিটি আমদানির সিদ্ধান্তের বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শাহিন আরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।

সর্বশেষ খবর