মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
ববিতা এক্সক্লুসিভ

চলচ্চিত্রে বিভাজন কাম্য নয়

ববিতা। একাধারে সফল অভিনেত্রী ও প্রযোজক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ভূমিকা রেখে দেশের জন্য বয়ে এনেছেন অবারিত সম্মান। ৭ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, জহির রায়হান পদক এবং বাচসাস পুরস্কারসহ একাধিকবার অসংখ্য দেশি-বিদেশি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এবার তিনি অর্জন করলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬ তে আজীবন সম্মাননা। তার সাক্ষাত্কার নিয়েছেন —আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে বিভাজন কাম্য নয়

জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পাওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন—

ধন্যবাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। এই সম্মান আমার একার নয়, দেশ ও জাতির; যারা আমাকে ভালোবেসে শিল্পীর আসনে বসিয়েছেন। সবার প্রতি রইল প্রাণঢালা কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা।

 

১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রের জার্নি শুরু, দীর্ঘ ক্যরিয়ারের গল্প শুনতে চাই

এই গল্পের শেষ নেই, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মানে পুতুল খেলার সময় অভিনয়ে এসেছি। শ্রদ্ধেয় নির্মাতা জহির রায়হানের উৎসাহে ‘সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু। এতটুকু বয়সে বেশি কিছু বোঝার কথা নয়। তারপরেও একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবাত, ভোগাত। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। এ দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এখানে তখন আবদুল জব্বার খান, জহির রায়হান, এহতেশাম, মহিউদ্দিন, সালাউদ্দীন, সুভাষ দত্ত, খান আতা, আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান মিতা, কামাল আহমেদ, কাজী জহির প্রমুখের মতো গুণী নির্মাতাদের হাতে শিল্পমানের ছবি নির্মাণ হতো। সেগুলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেত না। আমন্ত্রণ জানানো হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ধুম ধাড়াক্কা বাণিজ্যিক ছবিগুলোকে। আমার  ছোট্ট মনে বাংলা ছবির প্রতি এই অবজ্ঞা খুব কষ্ট দিত। এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। এই বন্ধ্যত্ব কাটল। এদেশের ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসার ঝড় তুলতে শুরু করল। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তার ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে আমাকে কাস্ট করলেন। ছবিটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তুলল। ছবিটি নিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলাম। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম বুড়িগঙ্গা থেকে ভলগা হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। সবাইকে জানালাম ববিতা বাংলাদেশের মেয়ে, এসেছি বাংলা ছবির বিশ্বজয়ে।

সবাই সাদরে গ্রহণ করল এই দেশের ছবি আর ববিতাকে। রাশিয়ায় তখন বলিউড অভিনেতা রাজকাপুরের জয়জয়কার। বিমানবন্দর থেকে সব জায়গায় তার ছবি ব্লোআপ হতো। একসময় অবাক চোখে দেখলাম রাজকাপুরের ছবির পাশে ববিতার ছবি স্থান করে নিয়েছে। মানে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মানজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশ্বের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে আর্টিকেল তৈরি করল সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা ববিতাকে নিয়ে। বিশ্বের প্রধান চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে আমি হয়ে গেলাম ডার্লিং অব দ্য ফেস্টিভেল। ফেস্টিভেলের ওপেনিং আর ক্লোজিং হতো আমার হাতে। পৃথিবীর খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটিগুলোতে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশের উৎসবে বক্তব্য রাখতে সেসব দেশের ভাষা শিখেছি। শিল্পমান ও বাণিজ্যিক ঘরানা, দুই ধরনের ছবিতেই অভিনয় করেছি। অনেক সময় দেখেছি একটি ভালো ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে নির্মাতা পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না। তখন বিনা পারিশ্রমিকে সেই কাজ করে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হইনি; আর্থিক আর অন্য যেভাবে সম্ভব সহযোগিতা করেছি।

আমার অভিনয় জীবনের চলার পথে সাংবাদিকদের সহযেগিতা ছিল অফুরন্ত। তাদের গঠনমূলক লেখনীতে নিজের অভিনয়কে আরও শানিত করতে পেরেছি। মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে আগলে রেখেছেন বড় বোন সুচন্দা ও ছায়ার মতো পাশে থেকেছে ছোট বোন চম্পা। আর এসব সহযোগিতা, শ্রম আর সাধনা আজ আমাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননার মতো চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান এনে দিল। আমি দেশ, জাতি, চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

 

চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা কেমন দেখছেন?

বর্তমানে ভালো কাজ হলেও তা কম। নানা বিভাজন চলচ্চিত্র জগতের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এটি কাম্য নয়। চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা একটি পরিবারের সদস্যের মতোই। আমাদের সময় টুকটাক মনোমালিন্য যে হতো না তা কিন্তু নয়। পরক্ষণে হাসিমুখে মিলে যেতাম। এখন কেন তা হবে না? চলচ্চিত্রকারদের মনে রাখতে হবে এই রুপালি জগৎ হচ্ছে একটি ফুলবাগান; যা দেখে সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়। রুপালি তারাকে ভালোবেসে বুকের গভীরে ঠাঁই দেয়। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই হাসিমুখে সুন্দরের প্রার্থনা করুন। দেখবেন আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্বদরবারে আলো ছড়াবে।

 

চলচ্চিত্রে অনেক শিল্পী অসহায় অবস্থায় আছে, তাদের জন্য আপনার করণীয় কিছু আছে?

অবশ্যই, আমি আর শিল্পী সমিতি মিলে অসহায় শিল্পী আর এই জগতের সবার কল্যাণে কাজ করব। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে যেতে চাই। তাহলেই আমার চলচ্চিত্র জীবন পূর্ণতা পাবে।

 

চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন, অবসর কীভাবে কাটে?

চলচ্চিত্র থেকে দূরে থাকলেও আমার মন আর সত্তাজুড়ে সব সময় চলচ্চিত্রের বসবাস। মানসম্মত ছবি পেলে কাজ শুরু করতে চাই। আমি প্রকৃতিপ্রেমী। বাসায় অসংখ্য গাছ, মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাখি, কুকুর রয়েছে। এদের নিয়ে সময় কাটে মহাআনন্দে । আমার একমাত্র ছেলে অনিক। তাকে ঘিরেই আমার পৃথিবী। মাঝে মাঝে কানাডায় গিয়ে ওকে সঙ্গ দেই। ও সেখানে পড়াশোনা আর গবেষণা করছে। আর অনিক দেশে এলে তাকে মজার মজার রান্না করে খাওয়াই। তাছাড়া তিন বোন মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করি। এই তো আমার দিনরাত্রি এভাবেই কেটে যাচ্ছে...।

 

সর্বশেষ খবর