বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

শূন্যের কোঠায় চলচ্চিত্র নির্মাণ

ছবি শূন্যতার মাঝে একডজন ছবি নিয়ে ব্যস্ত মাহিয়া মাহি

আলাউদ্দীন মাজিদ

শূন্যের কোঠায় চলচ্চিত্র নির্মাণ

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহরতেই ছবি নির্মাণের আওয়াজ সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রকৃতপক্ষে ছবি নির্মাণ এখন শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। এতে বেকার হয়ে পড়ছে শিল্পী, নির্মাতা আর কলাকুশলীরা। সিনেমা হল বন্ধও রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত বোর্ডে সেন্সরের জন্য জমা পড়েছে মাত্র তিনটি ছবি। যা কোনো বড় বাজেটের নয়। ছবি তিনটি হলো— চল যাই, গুপ্তহত্যা এবং ফিফটি ফিফটি লাভ। অন্যদিকে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি জানায়, চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৭টি ছবি। এর মধ্যে আবার আমদানিকৃত কলকাতার বাংলা ছবিও ছিল। মাঝে প্রায় ১ মাস ছবির অভাবে মুক্তি বন্ধ ছিল। এফডিসি ও পরিচালক সমিতির তথ্য মতে নির্মাণের জন্য প্রায় সময় ছবি এন্ট্রি হয়। কিন্তু এন্ট্রিকৃত বেশিরভাগই আর নির্মাণ হয় না। কেন এই ছবি শূন্যতা? এর জবাবে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে বিভাজনই এর একমাত্র কারণ। বিভক্ত চলচ্চিত্রের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দুষছেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ বলছেন তার প্রতিষ্ঠান থেকে আর মাত্র দুটি ছবি নির্মাণ করা হবে। এগুলো হলো— দহন এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ছবি। এরপর তার প্রযোজনা সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ দেশে চলচ্চিত্রের বাজার সংকুচিত ও ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বল্প বাজেটের ছবি দর্শক  দেখবে না। বিগ বাজেটের ছবি বানাতে গেলে সিনেমা হলের নগণ্য সংখ্যা দিয়ে ছবির পোস্টারের খরচই তুলে আনা যায় না। এ জন্য যৌথ প্রযোজনা ছিল ছবির ব্যবসার জন্য মোটামুটি একটি ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র পরিবার নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যৌথ আয়োজনের নির্মাণকে ব্যাহত করেছে। বর্তমানে যৌথ আয়োজনের যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে তা ছবি ব্যবসার জন্য মোটেও সহায়ক নয়। আবদুল আজিজ অভিযোগ করে বলেন, চলচ্চিত্র পরিবার যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ, সাফটা চুক্তির আওতায় ছবি আমদানি-রপ্তানিসহ সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে। নিজেরাও ছবি নির্মাণ করে না। মানে চলচ্চিত্র শিল্পকে এখন নিঃশেষ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। আবদুল আজিজ জানান, তার প্রতিষ্ঠানের আগে নির্মিত মাত্র ৪টি ছবি এখন মুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এগুলো হলো— বেপোরোয়া, পোড়ামন-টু, ডিটেকটিভ এবং স্যাটার ডে আফটার নুন। অথচ গত বছর পর্যন্ত বছরে জাজের এক ডজনের মতো ছবি মুক্তি পেত। আজিজ জানান, ঈদুল আজহার পর ছবির অভাবে ত্রিশটি সিনেমা হল বন্ধ হওয়া এখন চূড়ান্ত। এতে সিনেমা হলের অভাবে কোনো প্রযোজক লোকসানের ভয়ে আর ছবি নির্মাণে আসবে না। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন জানান, ছবির অভাবে চলতি মাসে পাবনার দুটি সিনেমা হল বিনা ও বাণী বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সিনেমা হল বাঁচলেই চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচবে। আর সিনেমা হল রক্ষায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত ছবি। যা এখন আর নেই। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্টর মেশিন দিয়ে সিনেমা হল জিম্মি করে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রযোজক সমিতির নির্বাচিত কমিটি না থাকায় এবং সিনেমা হলের মেশিন ওই প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকায় ছবি মুক্তি ওই প্রতিষ্ঠানটিই নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিষ্ঠানটি কোনো ভালো ছবি মুক্তি পেতে গেলে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজেদের ছবি অথবা ভিনদেশি ছবি ওই সময়ে মুক্তি দেওয়ার পাঁয়তারা করে। ফলে প্রযোজকরা লোকসানের ভয়ে আর নির্মাণে আসতে চায় না বলে ছবি শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি মেশিনভাড়া বাবদ প্রযোজকের কাছ থেকে সপ্তাহে ১০ হাজার এবং সিনেমা হল মালিকের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা ভাড়া নিচ্ছে। সিনেমা হল মালিকরা প্রতিষ্ঠানটির কথা না শুনলে নানা অজুহাতে মেশিন খুলে নিয়ে যায়। এতে ছবি নির্মাণে আগ্রহ হারিয়েছে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা। জায়েদ খান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করে তাহলে আমরা তাকে স্বাগত জানাব ও সব ধরনের সহযোগিতা করব। তিনি আরও বলেন, প্রদর্শক সমিতি ‘ছবি নেই’, এই মিথ্যা অজুহাতে সিনেমা হল বন্ধের ভয় দেখিয়ে এ দেশে ভারতের ছবির বাজার তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সিনেমা হল আর মেশিনের সুষ্ঠু নিশ্চয়তা পেলে ছবির আর অভাব হবে না, সিনেমা হলও বন্ধ হবে না। চলচ্চিত্র শিল্পী ঐক্যজোটের সভাপতি অভিনেতা ডি এ তায়েব বলেন, চলচ্চিত্রের এমন দুঃসময় সত্ত্বেও দেশের প্রধান এই গণমাধ্যমটিকে রক্ষা করা দায়িত্ব বলে মনে করছি। তাই আমার সহধর্মিণী বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রডিউসার সমিতির সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত সহসভাপতি মাহাবুবা শাহরীন তার প্রযোজনা সংস্থা এস জি প্রোডাকশনের ব্যানারে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে ‘অন্ধকার জগত’ শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে এই ব্যানার থেকে। ছবিটি পরিচালনা করছেন বদিউল আলম খোকন। আর এতে অভিনয় করছি আমি, মাহিসহ দেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা। ডি এ তায়েব বলেন, আসলে ছোটবেলা থেকেই দেশীয় চলচ্চিত্রকে অন্তর দিয়ে হৃদয়ে লালন করে এসেছি। তাই চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়ে লাভ-লোকসানের কথা না ভেবে এই শিল্পকে রক্ষার যুদ্ধে নেমেছি। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন। নতুন কোনো অর্থলগ্নিকারক ছবি নির্মাণে এলে তাকে যেন হয়রানির মুখে পড়তে না হয় এবং তিনি যেন সর্বাত্মক সহযোগিতা পান সে ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া চলচ্চিত্রের মানুষ, যাদের মধ্যে অহংকার চরমে পৌঁছেছে এবং এই অহংকারের কারণে এই শিল্পে বিভাজন দেখা দিয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে তা দূর করতে হবে। কারণ অহংকার হলো পতনের মূল। অহংকার ত্যাগ করে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। এদিকে বর্তমানে নায়িকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছবি নিয়ে এগিয়ে আছেন মাহিয়া মাহি। তার প্রায় এক ডজন ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আর নায়কদের মধ্যে শাকিব খান, ফেরদৌস আর সায়মন প্রায় এক ডজন করে ছবি নিয়ে কাজের তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন। অন্যদের মধ্যে অল্প কয়েকজন হাতে গোনা ছবি আর বেশিরভাগ শিল্পী কলাকুশলী আর নির্মাতা ছবির অভাবে বেকার রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর