বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছবির অভাবে সংকটে সিনেমা হল

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবির অভাবে সংকটে সিনেমা হল

চালু হওয়ার মাত্র ৭ মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল ঢাকার বাইরে প্রথম প্রতিষ্ঠিত সিরাজদিখানের পিক্স সিনেপ্লেক্স। এই সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অত্যাধুনিক এই  সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করেছিলাম। এতে ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে। সিনেপ্লেক্স দুটি চালুর পর পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে লোকসান গুনে মাত্র ৭ মাসের মাথায় এগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। আমি এখন চরম হতাশ। ব্যাংক লোন কীভাবে শোধ করব বুঝতে পারছি না। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল সিনেমা হলের জন্য সর্বনিম্ন সুদে ঋণ দেবে। তাও হচ্ছে না। এই অবস্থায় এ দেশ অচিরেই সিনেমা হল শূন্য হয়ে পড়বে। গত বছরের ৩১ আগস্ট সিরাজদিখান বাজারের জে এইচ সিকদার কমপ্লেক্স টুতে এই সিনেপ্লেক্স দুটি চালু হয়।

প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল জানান, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাবে নব্বই দশকের শেষদিক পর্যন্ত দেশে থাকা প্রায় ১৪০০ সিনেমা হলের মধ্যে বন্ধ হতে হতে এখন ২৭৪টিতে এসে ঠেকেছে। যেগুলো চালু আছে সেগুলো চরম লোকসানের কবলে বন্ধের ধারাবাহিকতায় রয়েছে। ঢাকার বাইরে মফস্বলের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সিনেমা হলের দৈন্যদশার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করার পর কথা ছিল সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল শিল্পের সুবিধায় নেওয়া হবে। কিন্তু শিল্প ঘোষণার প্রায় ৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবেই বিশাল অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল নেওয়া অব্যাহত রেখেছে সরকার। এতে এই লোকসানি সিনেমা হল আরও ক্ষতি ও হয়রানির মুখে পড়েছে। তারা আরও বলেন এসব কারণে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রায় ২৫টি জেলা এখন সিনেমা হল শূন্য। এসব জেলার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে- নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, নড়াইল, মৌলভীবাজার, রায়পুর, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার। রাজধানী ঢাকায় ছিল ৪৪টি সিনেমা হল। এখন রয়েছে ১৮টি। সর্বশেষ গত বছরের ৬ এপ্রিল বন্ধ হয় কারওয়ান বাজারের ‘পূর্ণিমা’ সিনেমা হলটি। রাজধানীর পরেই চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোরকে চলচ্চিত্র দর্শকের স্বর্গ বলে গণ্য করা হতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল এলাকায় ৪৭টি হল ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১২টি হল টিকে আছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীনের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি প্রেক্ষাগৃহ। একসময় যশোরের পরিচিতি ছিল সিনেমা হলের শহর হিসেবে। ছিল ২১টি সিনেমা হল। এখন যশোরে মাত্র ৬টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে এখন মাত্র একটি সিনেমা হলে  চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার ৩১ হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৭টি। খুলনা মহানগরীতে সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে মাত্র ৪টি।

ডুমুরিয়া উপজেলার একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। নেত্রকোনা জেলা শহরের একমাত্র সিনেমা হল হীরামন ও নাটোরের সায়াবান বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেটের সাতটির মধ্যে একটি এবং রংপুরের পাঁচটির মধ্যে একটি টিকে আছে। দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুরে বর্তমানে মাত্র একটি করে হল চালু রয়েছে। ঝিনাইদহে ১৭টির মধ্যে ৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০টির মধ্যে ৬টি, বেলকুচিতে ১৭টির মধ্যে ২টি, চুয়াডাঙায় ১৪টির মধ্যে ২টি, নীলফামারীতে ২৪টির মধ্যে ১টি, পাবনায় ২৮টির মধ্যে ৭টি, মানিকগঞ্জে ৯টির মধ্যে ১টি, লক্ষ্মীপুরে ১০টির মধ্যে ১টি, ঠাকুরগাঁয়ে ১৫টির মধ্যে ৬টি, রাজবাড়ীতে ২০টির মধ্যে ২টি, রূপগঞ্জে ৬টির মধ্যে ১টি, রংপুরে ৫টির মধ্যে ১টি, সিলেটে ৭টির মধ্যে ১টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। সিনেমা হলের এমনই ক্ষয়ে যাওয়া অশুভ চিত্র আরও প্রকট হচ্ছে। সিনেমা হল মালিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হল আধুনিকায়নের জন্য গত ১০ বছর ধরে সরকারি উদ্যোগের কথা  শোনা গেলেও তা এখন পর্যন্ত মুখের কথায়ই সীমিত আছে। মিয়া আলাউদ্দীন ও উজ্জল বলেন, সম্প্রতি সরকার আবারও সিনেমা হল সংস্কার ও এতে আধুনিক প্রজেক্টর স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে আদৌ তা বাস্তবায়ন হবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া জেলা শহর এই প্রকল্পের আওতায় পড়বে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজধানীর বাইরে প্রথম স্থাপিত সিনেপ্লেক্স দুটি বন্ধ হয়ে যাওয়া দুঃখজনক এবং চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য অশনি সংকেত। এগুলো চালু রাখা নিয়ে শুরু থেকেই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কারণ পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাব। ঢাকায় অবস্থিত সিনেপ্লেক্সগুলো চালু রয়েছে ইংরেজি ছবির ওপর নির্ভর করে। মফস্বলের দর্শক ইংরেজি ছবি সেভাবে দেখে না। স্থানীয়ভাবে যখন নির্মাতারা কনটেন্ট দিতে পারছিল না তখন উপমহাদেশীয় ছবি আমদানির মাধ্যমে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলে তথাকথিত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের বিরোধিতার মুখে সরকার তা স্থগিত করে দেয়। এরপর কলকাতার বাংলা ছবি আমদানি করতে গেলে আবার এসব চলচ্চিত্রকার নামধারী অশুভ চক্র তাতেও বাধা দিয়ে উৎসবে তা মুক্তির ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। এতে প্রদর্শকরা আরও ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ উৎসব হলো চলচ্চিত্র ব্যবসার প্রধান মৌসুম। এই অশুভ চক্র এফডিসির মতো একটি কেপিআইভুক্ত এলাকায় সমিতির নামে আড্ডাবাজির ঘাঁটি গেড়ে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের নামে দীর্ঘদিন ধরে শুধু ফাঁকা বুলি আউড়াচ্ছে আর চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের নীল নকশা বাস্তবায়নের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের প্রতিরোধে সরকার বা চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কোনো মাথা নেই।

সর্বশেষ খবর