বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

যে কারণে আকর্ষণ হারাচ্ছে ঈদ নাটক

যে কারণে আকর্ষণ হারাচ্ছে ঈদ নাটক

ঈদের নাটক মানেই দর্শকের মনে বাড়তি আনন্দ যোগ হওয়া। এই উৎসবে মনের মতো নাটক দেখে আনন্দে ভাসার প্রত্যাশায় থাকে দর্শক। দর্শকদের মতে নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ থেকে ঈদ নাটকের আকর্ষণ ক্রমেই হারাতে শুরু করেছে। কিন্তু কেন? এর কারণ হিসেবে চলচ্চিত্র ও নাট্য ব্যক্তিত্বদের মতামত তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ক্ষমতা চলে গেছে এজেন্সির হাতে

আমজাদ হোসেন

শুধু ঈদ নাটক নয়, সারা বছরে কয়টি মানসম্মত নাটক নির্মাণ হয় তা ভেবে দেখতে হবে। আগে নাটক মানেই ছিল প্রবল দর্শক আকর্ষণ। বিটিভিতে ‘এ সপ্তাহের নাটক’, ‘এ মাসের নাটক’, ‘বিশেষ দিনের নাটক’ বেশ ঘটা করে দর্শক দেখে তৃপ্তি পেত। আর ঈদ উৎসবের নাটক হলে কোনো কথাই ছিল না। আমার জব্বার আলী নাটকের কথাই বলি। এখনো দর্শক এ নাটক খোঁজে। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে নির্মাণ হতো নাটক এবং গল্প, সময় উপযোগিতা, বিষয়বস্তুর কারণে এগুলোর জনপ্রিয়তা অনন্ত সময় ধরে দর্শক মনে রেখাপাত করত। এখন এই আকর্ষণ হারানোর কারণ অনেক। যেমন টিভি চ্যানেল বেড়েছে। এতে একজন নির্মাতাকে একই সঙ্গে অনেক নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে নাটকের মান ধরে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। অভিনয় শিল্পীদেরও একই অবস্থা। একসঙ্গে একই দিন একাধিক নাটকের শিডিউল দিতে গিয়ে অভিনয়ের প্রতি তাদের মনোযোগ আর আগ্রহ কোনোটিই থাকে না। ফলে নাটক হয়ে যায় দায়সারা গোছের। পাশাপাশি এখন নাটক চূড়ান্ত করার ক্ষমতা চলে গেছে এজেন্সির হাতে। তাদের মর্জিমাফিক নাটক হলে স্পন্সর পাওয়া যায়। এ কারণে মানের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া মেধাবী গল্পকার ও নির্মাতা ও শিল্পীর অভাব এবং অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপনের ভিড়ে ঈদের নাটক আকর্ষণ হারাচ্ছে ক্রমাগত। সবচেয়ে বড় কথা হলো টিভি চ্যানেলগুলো যে বাজেট বরাদ্দ দেয় তা দিয়ে কখনো একটি মানসম্মত নাটক নির্মাণ করা সম্ভব নয়।

 

নাটক এখন আর শিল্প কলার পর্যায়ে নেই

আলী যাকের

শুধু ঈদের নাটক আকর্ষণ বা মান হারাচ্ছে এ কথার সঙ্গে আমি একমত নই। বছর জুড়ে যেসব নাটক নির্মাণ বা প্রচার হয় তাতে কি মান থাকে? অতিমাত্রায় টিভি চ্যানেল হয়ে যাওয়ায় সময়ের অভাবে যত্ন নিয়ে নাটক নির্মাণ বা অভিনয়ের দক্ষতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। নাটক এখন আর শিল্প কলার পর্যায়ে নেই। ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত ভোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এগুলো এখন আর দর্শক রুচিতে সাড়া জাগাতে পারছে না। আগে শুধু বিটিভি ছিল। সেখানে বিচার বিবেচনা করে নাটক, নির্মাতা, অভিনয় শিল্পী, গল্পসহ আনুষঙ্গিক সব কিছুই নির্বাচন করা হতো। যে কারণে হুমায়ূন আহমেদ, আতিকুল হক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমানসহ অনেক নাটক নির্মাতা তৈরি হয়েছিল। একই সঙ্গে আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল হোসেন, হুমায়ন ফরীদি, সুবর্ণা মোস্তফা, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আফরোজা বানুসহ অনেক তারকা তৈরি হয়েছে। এখন অতিরিক্ত নাটক নির্মাণ, নাটকের বাজেট হ্রাসসহ একাধিক কারণে নির্মাণ আর অভিনয়, দুইয়ের মানই কমেছে। নাটক আর অভিনয়ে গভীরতা কমে গেছে। সমাজ বা পরিবারের গল্প এখনকার নাটকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কৌতুকের নামে চলে ভাঁড়ামি। ফলে দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে নাটক। তা ছাড়া বিজ্ঞাপন আধিক্যের যন্ত্রণা তো রয়েছেই। হ্যাঁ ঈদের নাটক নিয়ে দর্শকের আগ্রহ বেশি থাকে। তাই ঈদে মনের মতো নাটক না পেয়ে সহজেই  হতাশ হয় দর্শক। এ ব্যাপারে টিভি চ্যানেলগুলোকে সচেতন হতে হবে।

 

বড় সমস্যা হলো কাহিনীর দুর্বলতা

হানিফ সংকেত

এখন ঈদের নাটক হয়ে গেছে যান্ত্রিক। নাটকে কোনো অনুভূতি নেই। নাটক নির্মিত হয় মাত্র তিনটি চরিত্র নিয়ে। এগুলো হলো— প্রেমিক প্রেমিকা ও মোবাইল ফোন। নাটকে এখন বাবা, মা, ভাই বোন, বাঙালি সংস্কৃতি, দেশ ও সমাজের চিত্র, জীবন যাপনের চিরচেনা চরিত্র অনুপস্থিত। প্রেম ছাড়া এখন যেন আর কোনো গল্পই নেই। বড় সমস্যা হলো কাহিনীর দুর্বলতা। টিভি চ্যানেল বেড়ে যাওয়া নির্মাতা ও শিল্পী তড়িঘড়ি করে অল্প সময়ে প্রচুর কাজ করতে গিয়ে মানহীন কাজের কবলে পড়েন। স্ক্রিপ্ট সেটে এসে পড়া, স্ক্রিপ্টের গভীরে না যাওয়া, মেকআপ গেটআপ চরিত্র অনুযায়ী না হওয়া, বিদেশি চ্যানেলের উৎপাত, বিদেশি শিল্পী কলাকুশলীদের এসে কাজ করা এমন অনেক কারণে নাটক হারাচ্ছে দর্শক আকর্ষণ। নাটক চলে গেছে এজেন্সির নিয়ন্ত্রণে। তাই টিভি চ্যানেলের পক্ষে নাটকের মান, নির্মাতা আর শিল্পী দেখার সুযোগ থাকে না। টিভি চ্যানেল বাজেটও কমিয়ে দিয়েছে। এতে চরিত্র, লোকেশন কমাতে হয়। ফলে নাটক হয় দুর্বল। কাহিনীকারেরও অভাব চলছে। আগে বড় মাপের লেখকরা মিডিয়ায় চুলচেরা বিশ্লেষণে সমালোচনাও লিখতেন। এখন কেউ সমালোচনা লিখে না। পছন্দমতো যে কাউকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেওয়া হয়। আর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় দর্শক আগ্রহ নষ্ট হওয়ার কারণ রয়েই গেছে। এ ব্যাপারে টিভি চ্যানেলকে সচেতন হতে হবে। এজেন্সি নির্ভরতা কমিয়ে বাজেট বাড়াতে হবে। না হলে নাটকের আকর্ষণ কোনোদিনই ফিরিয়ে আনা যাবে না।

 

যথাযথ বাজেট আর পরিকল্পনা দরকার

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

‘ঈদের নাটক আকর্ষণ হারাচ্ছে’ একথার সঙ্গে অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করব। আমি মনে করি দর্শক যে সময়টাতে টিভির সামনে বসে থাকে সেটি হচ্ছে ঈদের সময়। ঈদকে কেন্দ্র করে গত ৪/৫ বছরে বহু আলোচিত প্রোডাকশন হাউস চালু হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওয়াহিদ আনামের ‘ছিন্ন’, সুমন আনোয়ারের ‘রাতারগুল’, শিহাব শাহিনের ‘মন ফড়িংয়ের গল্প’, আশফাক নিপুণের ‘ল্যান্ড ফোনের দিনগুলোতে প্রেম’, আদনান আল রাজীবের ‘বিকাল বেলার পাখি’, মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘বড় ছেলে’, সাগর জাহানের ‘আরমান ভাই’ প্রভৃতি। অনেক মেকার আছেন যেমন মাবরুর রশীদ বান্নাহ, রেদোয়ান রনি, মোস্তফা কামাল রাজ, ইমেল হক, শরাফ হোসেন জীবন, ইফতেখার ফাহমি, হুমায়ুন সাধু, ফাহাদ খান, আশুতোষ সুজন প্রমুখ। তবে এটিও সত্য যে, আমাদের প্রোডাকশনের সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে ভালো নির্মাণ পাওয়া যাচ্ছে না। যথাযথ বাজেট, সময় এবং উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকলে আমাদের তরুণ নির্মাতারা আরও মানসম্মত মানে ভালো কাজ উপহার দিতে পারবে। বর্তমান সময়ে নাটকের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক নামি-দামি ব্র্যান্ড এগিয়ে আসছে। যেমন গত বছল হয়েছিল ‘ছবিয়াল রিইউনিয়ন’, অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প আর এ বছর আমরা করছি ‘ভাই ব্রাদার্স এক্সপ্রেস’ ইউনিলিভারের সৌজন্যে। আসলে ঈদের সময় মানসম্মত নাটক নির্মাণে যে এনার্জি দেখা যায় তা সারা বছর ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশের টিভি নাটক ও অনুষ্ঠানের চেহারা বদলে যাবে।

সর্বশেষ খবর