শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নেই জীবনঘনিষ্ঠ গল্প, নির্মাণ, অভিনয়, গান

যে কারণে চলচ্চিত্র হারাচ্ছে দর্শক

আলাউদ্দীন মাজিদ

নেই জীবনঘনিষ্ঠ গল্প, নির্মাণ, অভিনয়, গান

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ এর কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শ্বিকতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবে। এর জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। মানে, প্রয়োজন সময় উপযোগী গল্প। অনুপম হায়াৎ এর কথায় এরপর আসে বলিষ্ঠ চিত্রনাট্য ও দক্ষ নির্মাণ। সব শেষে শক্তিশালী অভিনয় জরুরি। এ ছাড়া গান আর দৃশ্যায়নের মুনশিয়ানা তো আছেই।

১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ঢাকার প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল পারিবারিক গল্পের ছবি। এতে নানা চরিত্রের শক্তিমান উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। একটি সমৃদ্ধ গল্প ও চরিত্রের ছবি বলে এটি দর্শক সাদরে গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় নির্মিত হতে থাকে আকাশ আর মাটি. মাটির পাহাড়, এদেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, কখনও আসিনি, সূর্যস্নান, সুতরাং, বেহুলা, মনের মতো বউ, নয়নতারাসহ প্রচুর গল্প ও চরিত্রসমৃদ্ধ ছবি। একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো—  নানা, নানী, দাদা, দাদি, মা, বাবা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক,আত্মীয়-স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। আর এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এতে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার  চিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে উপভোগ করত ছবিটি। এ কারণেই ৫০ থেকে আশির দশকের চলচ্চিত্রের ছিল স্বর্ণালি যুগ। এ সময় ফোক, নারীর যন্ত্রণাক্লিস্ট চিত্র, প্রেম, গ্রাম্য মোড়লের আধিপত্য থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকদের মনে চলচ্চিত্রকে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হতো। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতি, ছুটির ঘণ্টা, ডুমুরের ফুল, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, হাজার বছর ধরে, হাছন রাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা প্রভৃতি। আশির দশক পর্যন্ত এ জাতীয় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র প্রচুর পাওয়া গেছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা এসব মৌলিক গল্প বিবর্জিত ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে অ্যাকশন ছবির নামে মারদাঙ্গা গাঁজাখুরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। এই অবস্থা এখনো চলছে। এরপর শুরু হয় অশ্লীলতা ও পাইরেসির দাপট। মাঝে মধ্যে দু-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছবিতে পরিবার আর গল্প খুঁজে পাওয়া যেত। আর তাতে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় করত। এখনকার ছবিতে গল্প আর চরিত্রের সংকট। এখন ছবিতে আর নানা-নানী, দাদা দাদি তো দূরে থাক মা-বাবাই থাকে না। কমেডির নামে ভাঁড়ামি চলে। আগে কমেডিয়ানরাও ছিল রীতিমতো তারকা। ছবিতে এখন চরিত্র কমে গেছে। একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক আর আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, এখনকার ছবিতে গল্পই তো নেই চরিত্র থাকবে কীভাবে। বর্তমানে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছে তাতে যাপিত জীবনের উপকরণ নেই। এসব গল্প ও জীবনবোধের ছায়াহীন ছবি দর্শক কেন দেখবে। দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শক আগ্রহ নষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ হলো পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাব। সত্যিকার অর্থে ছবি নির্মাণের পরিবর্তে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ছবি নির্মাণের নামে প্রতারণা। এই প্রতারণার নাম ‘মহরত সর্বস্ব ছবি’। এ ধরনের ছবির নাম এফডিসিতে এন্ট্রি করে হয় জমকালো মহরতের মাধ্যমে। তারপর  ভোগবিলাস থেকে শুরু করে স্পন্সরের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনৈতিক কর্ম করে থাকে এসব ছবির প্রযোজক নামধারী সংঘবদ্ধ একটি চক্র। প্রায় সময়ই দেখা যায় তথ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে নানা ফায়দা লুটে ওই নামধারী নির্মাতারা। এসব ছবি আর নির্মাণ হয় না। অনেক ছবির আবার লোকদেখানো কিছুটা শুটিংও হয়। এটি হয় বিশেষ করে স্পন্সরদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে অর্থ আদায় আর ভোগবিলাসের জন্য। বেশিরভাগ          মহরত সর্বস্ব ছবিতে লোভ দেখিয়ে নতুন মেয়ে আনা হয়। তারপর ভোগবিলাসেই সীমিত হয়ে যায় ছবি। নির্মাণ আর হয় না। এফডিসি বা পরিচালক সমিতিতে এমন শতাধিক এন্ট্রিসর্বস্ব ছবির নাম রয়েছে।

সর্বশেষ খবর