রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বদি ভাইয়ের মহাপ্রস্থান

বদি ভাইয়ের মহাপ্রস্থান

আবদুল কাদের - ১৯৫১-২০২০

২০ ডিসেম্বর চেন্নাই থেকে দেশে ফিরেই প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতকে ফোন দিয়ে অভিনেতা আবদুল কাদের বলেন, ‘আমি দেশে ফিরে এসেছি, আর কোনো চিন্তা নেই, আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আবদুল কাদের হয়তো জেনে গিয়েছিলেন তাঁর হাতে আর সময় নেই, তাই জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরতে পেরে এই ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে, দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। গতকাল গুণী এই অভিনেতার মহাপ্রস্থান হলো। বেদনাবিধুর এই বিদায়ে তাঁর বর্ণময় জীবনের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও পান্থ আফজাল

 

সকালেই এলো দুঃসংবাদ

ইদানীং ঘুম ভাঙে অজানা আতঙ্কে।

বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই শুনতে হয় কোনো না কোনো দুঃসংবাদ। প্রিয়জন, স্বজন, আপনজনদের বিদায় সংবাদ শোনাটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে চলতি বছর মানে ২০২০ সালে প্রায় প্রতিদিন এমন ঘটনাই ঘটে। তাই ২০২০ সালকে সবাই এখন ‘বিষ’ বলেই আখ্যায়িত করেছে। গতকালের সকালটাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। খবর এলো জনপ্রিয় অভিনেতা আবদুল কাদের আর নেই। মনটা বিষাদে ভরে গেল। এমন একজন ভদ্র সজ্জন মানুষ এবং দক্ষ অভিনেতার কথা এ দেশের মানুষের মন থেকে কখনো মুছে যাবে না। তাঁর মৃত্যুতে শোবিজ জগতে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। সবার অশ্রুসিক্ত প্রশ্ন-সত্যিই কি বদি ভাই আর নেই?

 

অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হলো তাঁর

প্যানক্রিয়াসের (অগ্ন্যাশয়) ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন ‘বদি’ খ্যাত নন্দিত অভিনেতা আবদুল কাদের। শনিবার সকাল ঘড়ির কাঁটা যখন ৮টা ২০-এর ঘরে তখনই মৃত্যুদূত কেড়ে নিল এই অভিনেতার প্রাণ। বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা যেন তাঁর সঙ্গে বিদ্রোহ হরে চলছিল। এই বিদ্রোহকে কাবু করতে ৮ ডিসেম্বর উড়াল দেন ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানকার ক্রিস্টিয়ান মেডিকেল হাসপাতালে ধরা পড়ে তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। চিরপ্রস্থান নিশ্চিত জেনে ২০ ডিসেম্বর ফিরে আসেন দেশে। তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল শেষ নিঃশ্বাসটা প্রিয় দেশের মাটিতেই ফেলবেন। মরণের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলেও তার অন্তিম ইচ্ছাই পূরণ হলো। চির ঘুমে শায়িত হলেন জন্মভূমির কোলে।

 

‘বদি ভাই’ থেকে ‘মামা’

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর ‘বদি’ চরিত্র দিয়ে প্রথম সবার নজরে আসেন আবদুল কাদের। সেটি নব্বই দশকের কথা। এরপর তিন দশক ধরে তিনি হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’তে জনপ্রিয়তা পান ‘মামা’ চরিত্রে হাজির হয়ে।

 

বদি চরিত্র নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া

‘বদি’ চরিত্রটিকে তিনি কীভাবে উপভোগ করেন, ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর বিবিসি বাংলার কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা আবদুল কাদের এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকের দুুটি চরিত্র বাকের ভাই ও বদি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তখন মানুষ স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’ আর আমার বাসার চারপাশে পোস্টার লাগানো হয়েছিল ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে বদি তুমি ভাসবে খালে বিলে’। নাটকটি প্রচার হলে প্রথমে বদি চরিত্রটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল। পরে রাগ, ক্ষোভ ঘৃণা জন্মায়। একজন অভিনেতা হিসেবে এখানেই আমার সার্থকতা। কারণ আমি চরিত্রটিকে সত্যি সত্যি নিজের মধ্যে ধারণ করে দর্শকের মনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছিলাম। দর্শক বদি চরিত্রটির প্রতি শেষে ক্ষেপে যাওয়ার কারণ ছিল প্রথমে বাকের ভাইয়ের খুব প্রিয় সহকারী থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঘটনা চক্রে বদির মিথ্যা সাক্ষীর কারণে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির কারণে এতটাই পাবলিক থ্রেড আসে যে হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর নামে থানায় জিডি করতে হয়েছিল। নাটকটি প্রচারের রাতে আতঙ্কে দুজনকেই নিজের বাসার পরিবর্তে অন্য বাসায় গিয়ে থাকতে হয়েছিল। এতটা সময় পরেও আমি বদি নামে এখনো এতটা জনপ্রিয় এ কথা ভাবতেই অনেক ভালো লাগে।

 

অভিনয় জীবন

স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’  নাটকে অভিনয় শুরু। ১৯৭২ সালে আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন এবং মহসিন হলে সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান ‘বলুন দেখি’তে চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য হিসেবেও পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত থিয়েটারের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনায় অভিনয় এবং ১০০০টিরও বেশি প্রদর্শনীর অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, এখনো ক্রীতদাস, তোমরাই, স্পর্ধা, দুই বোন, মেরাজ ফকিরের মা। টেলিভিশনে ২ হাজারের বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৭৩ সাল থেকে রেডিও নাটকে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন।

 

এক নজরে

জন্ম : মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার সোনারং গ্রামে।

বাবা : আবদুল জলিল

মা : আনোয়ারা খাতুন

স্ত্রী : খায়রুন্নেছা কাদের

সন্তান : এক ছেলে ও এক মেয়ে

শিক্ষাজীবন : সোনারং হাইস্কুল ও বন্দর হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স ও এমএ করেন। অর্থনীতিতে সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে অধ্যাপনা এবং বিটপি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরির পর ১৯৭৯ সালে ‘বাটা’তে যোগ দেন কর্মকর্তা হিসেবে।

সর্বশেষ চাকরি : তিনি বাটা থেকে চাকরি পরিবর্তন করে বে এম্পোরিয়াম লিমিটেডের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

উল্লেখযোগ্য নাটক : মাটির কোলে, নক্ষত্রের রাত, শীর্ষবিন্দু, সবুজ সাথী, তিন টেক্কা, যুবরাজ, আগুন লাগা সন্ধ্যা, এই সেই কণ্ঠস্বর, আমার দেশের লাগি, প্যাকেজ সংবাদ, সবুজছায়া, কার ছায়া ছিল, দীঘল গায়ের কন্যা, কুসুম কুসুম ভালোবাসা, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, মোবারকের ঈদ।

চলচ্চিত্র : রিয়াজ ও শ্রাবন্তীর সঙ্গে ‘রং নাম্বার’ চলচ্চিত্রেও দারুণ অভিনয় করে দর্শকের মনে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন : ক্যারিয়ারে তিনি প্রচুর বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন।

 

শোকগাথা

মনটা বিষণ্ন : আসাদুজ্জামান নূর

এত প্রিয় একজন মানুষের চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমার মনটা বিষণ্ন। আমি আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মীকে হারালাম। টেলিভিশনে বেশ কিছু কাজ একসঙ্গে করেছি আমরা। কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিকের মতো আলোচিত নাটকেও একসঙ্গে কাজ করেছি। টিভি নাটকের ক্ষেত্রে বদি চরিত্রটি বহু বছর মানুষ মনে রাখবে। সব প্রিয়জন চলে যাচ্ছেন। মনটা বিষণ্নতায় ভরে থাকে প্রিয়জনদের মৃত্যুর খবরে।

 

শান্তিতে থাকুন : সুবর্ণা মুস্তাফা

১৯৮৬-তে  ফরীদি এবং আমি ভারতে যাচ্ছিলাম। ফ্লাইট ছিল পরের দিন। হঠাৎ দরজায় নক। তখন দেখি কাদের ভাই একটা ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত। তিনি ক্যামেরাটা আমাদের দিয়ে বললেন, ‘ইন্ডিয়া যাবা, সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখবা আর ছবি তুলবা’- এমনটাই ছিলেন কাদের ভাই! বলাবাহুল্য যে, তখন আমাদের কোনো ক্যামেরা ছিল না। কাদের ভাই কীভাবে এই বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন, আজ অবধি আমার কোনো ধারণা হলো না! এটি আসলেই একটি স্মরণীয় স্মৃতি। শান্তিতে থাকুন কাদের ভাই; আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি।

 

কষ্টের খবর : হানিফ সংকেত

আমাদের জন্য খুবই কষ্টের খবর। অক্টোবরে সর্বশেষ তিনি ‘ইত্যাদি’র শুট করেছিলেন। সে সময় তাঁকে অসুস্থ দেখেছি। আমাকে বললেন, ‘শরীরটা ভালো না, দোয়া করবেন।’ উনি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। দীর্ঘ তিন দশক তিনি ইত্যাদির মামা-ভাগ্নে পর্ব করেন। তিনি যখন চেন্নাই গেলেন সেখান থেকে ফোনে এবং দেশে ফিরেও বিমানবন্দরে নেমে কথা হয়েছে ভিডিওকলে। অনেক কান্না করলেন। বললেন, ‘হানিফ ভাই, জানি না আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না। দোয়া করবেন যেন দেখা হয়। কাদের ভাই চলে যাওয়া মানে পরিবারের একজন চলে যাওয়া। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

শিশুসুলভ ছিলেন : জর্জ

পরস্পরকে চিনি প্রায় ৩৫ বছর হলো! ১৯৯৩ সালে ‘কোথাও কেউ নেই’ দিয়েই আমার টেলিভিশনে অভিষেক হয়। তবে থিয়েটার করার কারণে কাদের ভাইয়ের সঙ্গে আগে থেকেই চেনা-জানা। প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময় আমার সঙ্গী ছিলেন তিনি। তাঁর মনটা ছিল সুন্দর, শিশুসুলভ মানুষ ছিলেন তিনি। সবসময় হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁকে রাগতে দেখিনি; মন খারাপ অবস্থায়ও তাকে পাইনি। এই ভালো মানুষটি যে এত দ্রুতই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, তা ভাবনার বাইরে ছিল! এই প্যান্ডেমিক অবস্থায় কে থাকবে আর কে থাকবে না, তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রিয় মানুষকে হারাচ্ছি। খুবই কষ্ট হচ্ছে কাদের ভাই চলে যাওয়ায়। কাদের ভাই যেখানেই যান, আমাদের মাঝেই থাকবেন।

 

স্তব্ধ হয়ে গেছি : মাহফুজ

প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুঃসংবাদ আসছে। কিছুদিন আগে হীরা ভাই চলে গেলেন; আর আজ কাদের ভাই! আমার মন খুব খারাপ। এই চলে যাওয়া মানতেই পারছি না। আমরা যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তারা কেউ তাঁর স্নেহের কথা ভুলবে না। সবসময় মজা ও আনন্দের মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের সেটে আমরা যখন একসঙ্গে কাজ করতাম, তখন তিনি ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। ভাবি সেটে খাবার নিয়ে আসতেন। এই সুন্দর মনের মানুষটির ভিতরে ভিতরে এমন মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছিল, তা জানতাম না। তাঁর এমন মৃত্যু অবাক করে দিল সবাইকে। কাউকে কিছু বলার সময় দিলেন না। তিনি চলে গেলেন, মানতেই পারছি না!

 

ভালো মানুষ ছিলেন : আফজাল

‘ইত্যাদি’র কারণে কাদের ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ দুই দশক ধরে পরিচয়। মঞ্চ থেকে পরিচয়ের পর কত অনুষ্ঠান, নাটক আর দীর্ঘ ধারাবাহিক করেছি তার হিসাব নেই।

মনোমালিন্য হয়েছে তাঁর সঙ্গে, এমন আর্টিস্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি যেমন ভালো মানুষ ছিলেন, তেমনি ভালো অভিনেতাও। তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে আমার বুবু। তাই কাদের ভাইকে দুলাভাই ডাকতাম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর