রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

চিরদিনের নায়করাজ রাজ্জাক

চলচ্চিত্রের যে কোনো উৎসবে মধ্যমণি হয়ে থাকেন একজনই। তিনি নায়করাজ রাজ্জাক। আজ তাঁর ৮০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

চিরদিনের নায়করাজ রাজ্জাক

জন্ম : ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২, মৃত্যু : ২১ আগস্ট ২০১৭

নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি। একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কিশোর বয়সে কলকাতার মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয়ে যাত্রা শুরু তাঁর। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে সাধারণ মানুষ হিসেবে রাজ্জাক পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন প্রায় অসহায় অবস্থায়। কঠোর পরিশ্রম আর জীবনে প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে সংগ্রাম করে হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে   টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সবার কাছে জনপ্রিয় হন তিনি। ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে নায়ক হিসেবে ঢালিউডে প্রথম উপস্থিত হন এবং সবার মন জয় করে নেন। দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নায়করাজ উপাধি পান। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। চারবার জাতীয় সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর সফল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্র তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’-এ ভূষিত করে। রাজ্জাক অসীম মনোবল, অমানুষিক পরিশ্রম আর মমতার মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি হয়েছেন। রাজ্জাকের জন্ম কলকাতার সিনেমাপাড়া টালিগঞ্জে। জন্মের পর থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বপ্ন ছিল সিনেমাকে ঘিরে। টালিগঞ্জের সিনেমা শিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিৎদের যুগ। এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতায় থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। বললেন, ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। ভদ্রলোক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা আবদুল জব্বার খানের পরিচিত। তিনি রাজ্জাককে পাঠালেন তাঁর কাছে একটা চিঠি দিয়ে। রাজ্জাক ঢাকায় এসে কমলাপুরে বাসা নেন। এরপর চিঠি নিয়ে জব্বার খানের কাছে যান। তিনি রাজ্জাককে ইকবাল ফিল্ম লিমিটেডে কাজ করার সুযোগ দেন। ‘উজালা’ ছবির মধ্য দিয়ে শুরু হলো রাজ্জাকের ঢাকার চলচ্চিত্রজীবন। একসময় জহির রায়হানের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। লোককাহিনি নিয়ে জহির রায়হান তখন ‘বেহুলা’ ছবিটি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। জহির রায়হান তাঁকে বললেন, আপনিই আমার ছবির নায়ক। জহির রায়হানের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ লখীন্দর হয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হলেন রাজ্জাক। তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা। বেহুলা ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। ছবিটি সুপারহিট হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পায় আরেকজন অপরিহার্য নায়ক। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নির্মিত বেশিরভাগ ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক। বাংলাদেশে পাক-ভারতীয় ছবির প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যাঁদের ওপর পড়ে রাজ্জাক তাঁদের মধ্যে একজন। দক্ষতা এবং নৈপুণ্যতার সঙ্গে রাজ্জাক একের পর এক ছবিতে অভিনয় করে যান।  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনীত ‘মানুষের মন’ ছবিটি। এটি ব্যবসাসফল হওয়ায়  নতুনভাবে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র জেগে ওঠে। এ ছবির মধ্য দিয়ে শুরু হলো চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ্জাকের যুগ। এরপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ছবি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’, শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবিতে অভিনয় করে রাজ্জাক হয়ে যান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আইকন। রাজ্জাক তাঁর দুই ছেলে বাপ্পারাজ এবং সম্রাটকে নিয়ে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন নিজের নির্মিত ‘কোটি টাকার ফকির’ ছবিতে। দুই ছেলেকে নিয়ে অভিনয় করাকেই রাজ্জাক তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি মনে করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। সবকিছুই আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তবে একটা কষ্ট আছে, তা হলো- আমার বড় মেয়ে শম্পার অকাল মৃত্যু। ও বেঁচে থাকলে আমরা সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ পরিবার নিয়ে গর্ববোধ করতে পারতাম।’ নায়করাজের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায়। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন দেশীয় চলচ্চিত্রের এ অবিসংবাদিত রাজা।

 

একনজরে নায়করাজ

♦ জন্ম : ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি।

♦ পুরো নাম : আবদুর রাজ্জাক।

♦ বাবা : আকবর হোসেন।

♦ মা : নেসারুন্নেসা।

♦ স্ত্রী : খায়রুন্নেসা (ভালোবেসে লক্ষ্মী বলে ডাকতেন)।

♦ সন্তান : তিন ছেলে ও দুই মেয়ে

♦ অভিনয়ের শুরু : সপ্তম শ্রেণিতে     পড়ার সময়।

♦ প্রথম নায়ক হিসেবে অভিনয় : বেহুলা।

♦ প্রথম নায়িকা : সুচন্দা।

♦ জুটি হিসেবে জনপ্রিয়তা : কবরীর সঙ্গে।

♦ প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্র : রংবাজ (রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন্স), পরিচালক জহিরুল হক। বিপরীতে কবরী।

♦ প্রযোজনায় বিরতি : ২০০০ সালে ‘মরণ নিয়ে খেলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে।

♦ প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র : অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), বিপরীতে ববিতা।

♦ সর্বশেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র : আয়না কাহিনী (২০১৪)।

♦ সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র : ‘কার্তুজ’।

♦ নায়ক হিসেবে যাদের বিপরীতে কাজ করেছেন : সুচন্দা, কবরী, শবনম, শাবানা, নাসিমা খান, সুজাতা, ববিতা, কবিতা, নূতন, অঞ্জনা, কাজরী।

♦ অভিনয়ে পারিবারিক সমর্থন : শুধু মেজ ভাই আবদুল গফুর।

♦ চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা : আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে ‘উজালা’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে।

♦ নায়ক হিসেবে অভিনয় : ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। নায়ক হিসেবে শেষ চলচ্চিত্র ‘মালামতি’।

রাজ্জাক ছিলেন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী : সুচন্দা

রাজ্জাক ছিলেন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। তাঁর শূন্যতা আমরা বহন করছি। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘বেহুলা’ দিয়ে যাত্রা শুরু করে আনোয়ারা, জুলেখা, দুই ভাই, সংসার, প্রতিশোধ, অশ্রু দিয়ে লেখা, রাজবন্দী, জীবনতৃষ্ণাসহ প্রায় ২৫-৩০টি চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করেছি। রাজ্জাক শিল্পী হিসেবে যেমন ছিলেন কাজের প্রতি আন্তরিক, তেমনি মানুষ হিসেবে ছিলেন বিনয়ী এবং সজ্জন। সহশিল্পীদের সহযোগিতায় তিনি সব সময় এগিয়ে আসতেন। জন্মদিনে তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকুক এটাই আমার প্রার্থনা।

 

আমি তাঁকে বলি দার্শনিক : ববিতা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাক এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। রাজ্জাকের নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস ‘রাজলক্ষ্মী’র বেশির ভাগ ছবিতে অভিনয় করতে পেরে আমি গর্বিত। জন্মদিন মানেই নায়করাজকে ঘিরে থাকত অন্যরকম আয়োজন। প্রিয় মানুষের আলোয় আলোকিত হতো সবাই। তৈরি হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। রাজ্জাক ভাই কখনো চাইতেন না তাঁকে নিয়ে ঘটা করে কোনো আয়োজন হোক। আমার ডাকনাম পপি। তিনি আমাকে পপ বলে ডাকতেন। সেই ডাকটি এখনো কানে বাজে। স্মৃতির দুয়ারে আজও অম্লান প্রিয় মানুষটি। আমি তাঁকে বলি দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর অগাধ মমতা ছিল। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে ৪০টি ছবিতে নায়িকা হয়েছি। আমরা একই গুরুর শিষ্য। জহির ভাইয়ের (জহির রায়হান) হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছি।

সর্বশেষ খবর