আজ খ্যাতিমান-কিংবদন্তি গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের জন্মদিন। হৃদয়ের গালিচা পেতে, বাতাসে গোলাপ পাপড়ি ছিটিয়ে, পুণ্যময় জীবনের প্রশস্ত পথে, প্রার্থনার ভূমিতে, ফুলের পালকযুক্ত শিরস্ত্রাণ পরিয়ে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকে জন্মদিনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
গীতিকবি রফিকউজ্জামানকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে, এটাকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি গুরুতর ‘ধৃষ্টতা’ মনে করতাম। চেতনার দিগন্ত উন্মোচিত করে পিপাসু মনে তাকে নিয়ে বিশুদ্ধ লেখা প্রকাশ করার দিকটাকে সবসময় বিপজ্জনক মনে করেছি। সুতরাং কয়েক দশক ধরে রফিকউজ্জামানের জন্মদিনে তাকে নিয়ে কিছু লেখার প্রবল ইচ্ছার হাতে হাতকড়া এবং পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষায় রেখে শেষ পর্যন্ত বিরতি দিয়েছি। কিন্তু এবার স্বআরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাহার করে রফিকউজ্জামানকে নিয়ে লেখার গুপ্ত আকাক্সক্ষা এবং দূরবর্তী স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার তাগিদ দিয়েছেন দেশবরেণ্য গীতিকবি ও সুরস্রষ্টা শ্রদ্ধাভাজন মিল্টন খন্দকার। তার মার্জিত নির্দেশকেই আমি সম্মানজনক এবং পুরস্কার হিসেবে কৃতার্থ চিত্তে গ্রহণ করে এ ক্ষুদ্র লেখার অবতারণা করছি।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/02.%20February/11-02-2023/11-02-2023-p8-9.jpg)
শব্দের মাঝে ডুবে থাকার পান্ডিত্য, জীবনবোধের গভীরতায় অবগাহন আর আত্মজ্ঞানের তৃষ্ণায় সত্যের সাধনায় মগ্ন গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। সংগীতের পলকে পলকে চিত্রকল্পের আবেগ, গভীর সৌন্দর্য, আশ্চর্য রকম উপমা, আভিজাত্য মেশানো নজির, পঙ্তির বিন্যাস, ভাবনার প্রতিমা এবং একাকিত্বের ভয়াল যন্ত্রণা প্রকাশে রফিকউজ্জামান সবার চেয়ে আলাদা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে আকর্ষণ এবং মুগ্ধ করে। গানের ক্যানভাসে তার আঁকা নকশাচিত্র, ঐশ্বর্যের সমাহার, প্রেমে ভস্মীভূত হৃদয়ের আর্তি, স্বর্গীয় বৈভব নিয়ে সংগীত নির্মাণের প্রয়াস ও ধ্যানমগ্নতা রফিকউজ্জামানকে গৌরব এবং গরিমার অধিকার দিয়েছে।
তিনি বাংলা সংগীতের অন্যতম তীর্থযাত্রী, সংগীতের উচ্চতম প্রতিকৃতি। তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে সংগীতের চারণভূমিতে যেন অনন্তকাল হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি কখনো সস্তা জনপ্রিয়তার শিকারে পরিণত হননি। অর্থের লোভে দ্রুত অসংখ্য গান লিখে ধুলোর তলায় ছড়িয়ে দেননি। কারও তোষামোদ বা স্তাবকতা করে প্রশংসা-সংগীত রচনা করে উচ্চ খ্যাতির লোভে রাষ্ট্রীয় পদক নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণে অমেরুদন্ডী প্রাণীতে পরিণত হননি। এখানেই রফিকউজ্জামানের মতো প্রকৃত মানুষের স্বার্থকতা।
রফিকউজ্জামান চিরকাল সংগীতের তীরভূমি ধরে পথ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। সংগীতের অসীম সমুদ্রে অনন্তকাল ধরে নোঙর ফেলেছেন। তিনি বিশাল নীরবতায় সংগীতের শস্য বপন করে যাচ্ছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জাগরণের ভিতরে সংগীতের স্বপ্ন তৈরি করে যাচ্ছেন। তিনি সংগীতের পালঙ্কের ওপর বিস্ময়কর নীরবতায় জীবনের দার্শনিকতাকে প্রতিস্থাপন করছেন।
রফিকউজ্জামান তার অতৃপ্ত বাসনা, আকুল আকাক্সক্ষা, দীর্ঘস্থায়ী বেদনা এবং গভীর শূন্যতা প্রকাশে সংগীতের বাইরেও চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচিয়তা, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার হিসেবে শিল্পকলার বিভিন্ন সৃজনশীল ক্ষেত্রে নিজের চেতনা ও উপলব্ধি অনবরত খোদাই করে যাচ্ছেন অনন্তকালের জন্য। হৃদয়ের বসন্ত উদযাপনে জীবনের অন্তঃস্থলে শব্দহীন গভীরতায় বাঙালি চিরকাল রফিকউজ্জামানকে অন্বেষণ করবে। বাঙালির প্রতিটি সূর্যোদয়ে এবং সূর্যাস্তে বিশাল নৈঃশব্দ্যের মাঝে নক্ষত্রের যে সংগীত ধ্বনিত হয়, রফিকউজ্জামান ক্রমাগত সেই সংগীতের ধ্বনিতে দৃশ্যমান থাকবেন।
সংগীতের স্বপ্নদর্শী মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কয়েকটি উল্লেখ না করলে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো অপরাধী মনে হবে।
‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু ব’লে গণ্য হলাম’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো’, ‘ভালোবাসা যতো বড়ো জীবন ততো বড়ো নয়’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, ‘আমার মতো এতো সুখী নয় তো কারো জীবন’, ‘আকাশের সব তারা ঝ’রে যাবে’, ‘সুখ পাখি রে পিঞ্জিরা তোর’, ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমি নদীর মতো বয়ে বয়ে’, ‘আমার বাউল মনের একতারাটা’, ‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে’, ‘সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘নদীর ধারে পথ-পথ পেরুলেই গাঁ’, ‘কতো হাজার বছর ধরে’, ‘চির অক্ষয় তুমি বাংলাদেশ’, ‘আমার মন পাখিটা যায় রে উড়ে যায়’, ‘দোয়েল পাখি গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙায়, মাঠের সবুজ থেকে সূর্যের লাল’, ‘স্বাধীনতা তোমার জন্য যে পারে বইতে’, ‘আমি নদীর মতো বয়ে বয়ে দুঃখ সুখের কথা কয়ে বাংলাদেশের গান হয়ে যাবো’, ‘আমাকে একটি দোয়েল বলেছে’।
রফিকউজ্জামানের ‘ভালোবাসা যতো বড়ো জীবন ততো বড়ো নয়’- এই গানটা যতবার শুনি ততবার সীমাহীন আনন্দে এবং ভালোবাসার পবিত্রতায় আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ভালোবাসা জীবনের চেয়ে বড় আবার জীবন স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। ভালোবাসা এক উচ্চতম মহত্তমবোধ যা আত্মার গোপনীয়তাকে বহন করছে, যা আত্মার ভিতর বসবাস করে আত্মার ভিতর চলাচল করে। ভালোবাসা হলো আত্মার বসন্ত। ভালোবাসা না থাকলে ঐশ্বরিক জীবন বেঁচে থাকার অনুমোদন হারায়। ভালোবাসা আত্মার নীরবতায় আত্মগোপন করে থাকে। মানুষ মাত্রই ভালোবাসার ক্যারাভানে সংযুক্ত হয়ে অনন্তকাল ভ্রমণ করছে।
‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক’- এ গান শ্বাসরুদ্ধ করার মতো। ধ্বংসস্তূপের ভিতর দিয়ে জীবনকে লালন করা। হৃদয়ের গভীর ক্ষতকে বেপরোয়াভাবে প্রশ্রয় দেওয়া, জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাওয়া। বিরহ যন্ত্রণার বেদির সামনে প্রেমের গিলোটিনে নিজেকে উৎসর্গ করা।
‘তুমি এমনি জাল পেতেছ সংসারে’- আমরা যতই প্রস্ফুটিত হই অদৃশ্য অসীম মহাশূন্যতাই আমাদের শেষ পরিণতি, হাহাকার আর বিলাপের নিচেই আমরা সমাহিত হই। জীবনের বৃক্ষ আমরা যতই রোপণ করি একদিন সব বৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে হবে, চিরন্তন মায়ার ফাঁদ ছিন্ন করতে হবে।
‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’- এ যেন মাতৃভূমি অর্জনের দুঃসাহসী বীরত্ব, ধ্বংসযজ্ঞ, বিভীষিকাময় আতঙ্ক, গৌরবময় পদচিহ্ন, দুঃস্বপ্নের স্মৃতি, রক্তাক্ত চিত্র ও আগ্রাসী থাবার চিত্রনাট্য, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নকশা। পূর্ব পুরুষদের মহিমা বা মুক্তিযুদ্ধের মহৎ প্রজন্মকে আমরা যেন ক্ষুদ্র স্বার্থে কালিমালিপ্ত না করি। খোকা ফিরে আসবে কি আসবে না- মা অপেক্ষারত অথচ খোকা অনন্তকালেও ফিরে আসবে না।
আত্মজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞান সমৃদ্ধ মরমি সাধনার ‘দেহখেয়ায় দেবো পাড়ি’ গ্রন্থে রফিকউজ্জামান বলেছেন-
‘মানুষ রূপের তত্ত্ব বোঝা
নয় রে সোজা সাধক বিনে
ত্রিকালে ত্রিসত্য আগে
বুঝতে হবে আপন চিনে।।
ত্রিভুবন ত্রিচোক্ষে রেখে
চিনতে হবে হিসাব দেখে
কোথায় ছিলে কোথায় এলে
কোথায় যাবে কি রং মেখে’
আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক লাওৎসে বলেছেন, জানা যেন তোমার জন্য বন্ধন বা কোনো সীমানা না হয়, অজ্ঞান থেকে উপরে উঠবে, জ্ঞান থেকেও উপরে উঠে যাও।
পাখির হাটে, ফসলের মাঠে, পারাপারের খেয়াঘাটে, অনুতাপের ললাটে, হৃদয় ভেঙে যাওয়া অশ্রুজলে, সংসার নির্বাণে, নীরবতার একাকিত্বে এবং অনন্তকালের সংগীতে রফিকউজ্জামান সদা হাজির থাকুন, আশীর্বাদপ্রাপ্ত হোন। জগৎ ও জীবনের অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য ও তাৎপর্য আবিষ্কার করুন, মহৎ সাধনায় নিবেদিত থাকুন।
জয়তু রফিকউজ্জামান। আপনার জন্মদিন শুভ হোক, মহিমান্বিত হোক।