সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে হানিফ সংকেত

আমাদের জন্য দর্শক নয়, দর্শকের জন্য আমরা

আমাদের জন্য দর্শক নয়, দর্শকের জন্য আমরা

হানিফ সংকেত-অনবদ্য প্রতিভা, কর্মনৈপুণ্য ও সাহসিকতায় যিনি নিজেই এখন একটি প্রতিষ্ঠান। কয়েক দশক ধরে এ দেশের মিডিয়া জগতে যিনি সবার জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন। ঈদ সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন বরেণ্য নির্মাতা হানিফ সংকেত। জানিয়েছেন দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশসেরা অনুষ্ঠান ইত্যাদিই ঈদের প্রধান বিনোদন কেন?  এই অসম্ভবকে কীভাবে সম্ভব করেছেন তিনি। এ বিষয় ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

একটি অনুষ্ঠানের এই দীর্ঘমেয়াদি জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখার কৌশল কী?

ইত্যাদি এক নম্বর কি দুই নম্বর এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি মনে করি, ‘আমাদের জন্য দর্শক নয়, দর্শকের জন্য আমরা’। দর্শকের মনে স্থান পাওয়ার বিষয়টিই আমাদের কাছে মুখ্য। সে জন্যই হয়তো এখনো ঈদের প্রধান বিনোদন ইত্যাদি। দর্শকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে তাদের মন-মানসিকতা বুঝে সময়কে ধরে বিষয়-বৈচিত্র্যে অনুষ্ঠান সাজাতে চেষ্টা করি। সংখ্যার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দিই। দর্শকরা সময় বের করে আমাদের অনুষ্ঠানটি দেখতে বসেন। এটাই আমার পরম পাওয়া।

 

প্রতি ঈদেই আমরা দেখি, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’ গানটি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে চিত্রায়িত হয়-এবারের এই গানের গল্প শুনতে চাই।

একসময় ঈদ অনুষ্ঠানমালায় এই গানটি ছিল একরকম অবহেলিত। একসময় বিটিভিতে চাঁদ দেখার পর এই গানটি অল্প কজন শিল্পীকে দিয়ে করা হতো। কিন্তু আমরা ভাবলাম এটি যেহেতু আমাদের ঈদের প্রধান সংগীত, তাই এর বর্ণাঢ্য উপস্থাপন হওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকেই মূলত ইত্যাদি গত তিন দশক ধরে বিভিন্ন আঙ্গিকে ঢাকায় ও দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ধারণ করে আসছি। আনন্দের বিষয় এখন এই গানটি ঈদের গানে পরিণত হয়েছে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতায় এবার নৃত্যে-ছন্দে-আনন্দে চিরচেনা এই গানটি পরিবেশন করবেন অর্ধশতাধিক শারীরিক প্রতিবন্ধী অদম্য মানুষ। যারা প্রমাণ করেছেন শারীরিক বা যে কোনো প্রতিবন্ধিতা অক্ষমতা নয়, বরং ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। সুযোগ পেলে তারাও পরিণত হতে পারে দক্ষ মানবসম্পদে। শতাধিক শিক্ষার্থী এই গানের চিত্রায়ণে অংশ নিয়েছে। এবারের ঈদে গানটির ভিন্নরকম চিত্রায়ণ দর্শকদের ভালো লাগবে।

এবারের ঈদ ইত্যাদির বিশেষত্ব কী? কী কী থাকছে অনুষ্ঠানে?

ইত্যাদির প্রতিটি পর্বই অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতি রেখে সমসাময়িক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয় বলেই হয়তো দর্শকরা প্রতিটি বিষয়ে বৈচিত্র্য ও আলাদা স্বাদ খুঁজে পান। এবারের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে একটি ভিন্নধর্মী দেশাত্মবোধক গান। যে গানের চিত্রায়ণে অংশ নিয়েছে আমাদের ক্রীড়া জগতের গৌরব বাংলাদেশ নারী ফুটবল ও নারী ক্রিকেট দল। এবারের নৃত্যায়োজনে তুলে ধরা হয়েছে তিনটি ধারাকে। রয়েছে চারজন তারকার অংশগ্রহণে ছন্দে ছন্দে একটি ব্যতিক্রমী আড্ডা। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবারের পর্বে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক বক্তব্য অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। মিউজিক্যাল ড্রামা পর্বে দেখা যাবে তিনজন ভারবাহী মানুষের চাপা কষ্টের আর্তনাদ। এবারকার দলীয় সংগীতে উঠে এসেছে সমাজের নানা অনিয়ম, অসংগতির চিত্র। দর্শক পর্বেও রয়েছে তারকা বনাম দর্শকদের মুখোমুখি অভিনয়। উল্লেখ্য, প্রতিটি পর্বেই দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছেন। আর অন্যান্য নিয়মিত পর্ব তো রয়েছেই।

 

ঈদ ইত্যাদির একটি জনপ্রিয় পর্ব হচ্ছে বিদেশিদের দিয়ে অভিনয়। প্রতিবার এত বিদেশি কীভাবে জোগাড় করেন? এবারের পর্বের বিষয়বস্তু কী?

দীর্ঘ দুই যুগ ধরে বিদেশিদের নিয়ে এই পর্বটি করার ফলে ইত্যাদি এবং আমার সঙ্গে বিদেশিদের একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো বিদেশি এ দেশে না থাকলেও বিদেশিরা তাদের বন্ধু-বান্ধব ও নতুন সহকর্মীদের ইত্যাদির ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ইমেইলে যোগাযোগ করেন। তারা ইউটিউবে বিদেশিদের পর্ব দেখে উৎসাহিত হন। জানতে চান বিদেশিদের নিয়ে পরবর্তী ইত্যাদি কবে হবে? সুতরাং আমাকে অভিনয়ের জন্য বিদেশি খুঁজতে কষ্ট হয় না। তারাই আমাকে খুঁজে নেন। বিদেশিরা মনে করেন, এটি তাদের জীবনে একটি নতুন অভিজ্ঞতা, অন্যরকম আনন্দ এবং শিক্ষণীয় বিষয়, যা মানুষকে সচেতন করতে সাহায্য করে। এবারের পর্বের বিষয়বস্তুও সবার জানা একটি বিষয়, বিষয়টি না হয় না-ই বা বললাম।

 

বরাবরের মতো এবারও আপনি নির্মাণ করেছেন পারিবারিক গল্পে সামাজিক বক্তব্যনির্ভর নাটক। আপনার নাটকের নামগুলো বেশ ছন্দময় এর কারণ কী?

আমি সব সময় ইত্যাদির মতো বক্তব্যনির্ভর সামাজিক সচেতনতামূলক পারিবারিক নাটক করতে চেষ্টা করি। এবারও তাই। আমার ভিউ নিয়ে চিন্তা নেই। চিন্তা করি পরিবারের সবাই মিলে মোবাইলের পর্দা নয়, টেলিভিশন পর্দার সামনে একসঙ্গে বসে যেন নাটকটি দেখতে পারেন। আর নামের কথা যদি বলেন, আমার উপস্থাপনা, আমার লেখা সব কিছুতেই আমি অনুপ্রাস দিতে চেষ্টা করি। আর নাটকের নাম শুধু ছন্দময়ই নয়-অর্থময়ও বটে। চেষ্টা করি নামের মধ্যে যেন নাটকের গল্পের ছোঁয়া থাকে। আর এ ধরনের নাম দিতে হলে অনেক ভাবতে হয়।

 

আমাদের দেশের দর্শকদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

দর্শকদের মধ্যে শ্রেণিভেদ আছে। রুচিশীল দর্শক যেমন আছেন, বিকৃত রুচির দর্শকও আছেন। এদের জন্যও একশ্রেণির নির্মাতা আছেন। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। আপনি ঠিক পথে থাকলে দর্শকরা বাঁকা পথে হাঁটবে না। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি সব কিছুকেই ফাঁকি দিতে পারবেন, দর্শকদের ফাঁকি দিতে পারবেন না। যে মুহূর্ত থেকে দর্শকদের ফাঁকি দেবেন, সেই মুহূর্ত থেকে দর্শকও আপনাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। তারা যাতে না যায় সেটা মাথায় রেখে আমরা কাজ করি। সে জন্য শুধু টিভিতেই নয়, ইউটিউবেও আমাদের অনুষ্ঠান ট্রেন্ডিংয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর