শিরোনাম
শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বলিউডের অপরূপা মধুবালা

বলিউডের অপরূপা মধুবালা

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা সুন্দরী অভিনেত্রীর তকমা আজও কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। একমাত্র এই আখ্যার অধিকারী ছিলেন মধুবালা। তাঁর সফল চলচ্চিত্র জীবন, ব্যর্থ প্রেম আর অকাল মৃত্যুর কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রেমের এক অপ্সরা দেবী

‘ইনসান কিসিসে দুনিয়া মে একবার মোহাব্বত করতা হ্যায়, ইস দর্দ কে লেকার জিতে হ্যায়, ইস দর্দ কে লেকার মরতে হ্যায়... পেয়ার কিয়াতো ডরনা কেয়া... যাঁর কণ্ঠে প্রেমের জন্য এমন আকুতি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন বলিউডের সর্বকালের সেরা সুন্দরী অভিনেত্রী মধুবালা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলেই হয়তো তাঁর ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছিল চলচ্চিত্র, দর্শক, নির্মাতা, সহশিল্পী এমনকি তামাম দুনিয়ায়। তাই তো আজও প্রেমের দেবী ভেনাসের সঙ্গে কারও তুলনা করতে গেলে প্রথমেই নির্দ্বিধায় চলে আসে মধুবালার নাম। সবার হৃদয়জুড়ে প্রেমের এক অপ্সরা দেবী হয়ে আছেন তিনি। থাকবেন চিরকাল।

 

৩৬ বছরের কষ্টের জীবন

জন্ম নিয়েছিলেন হৃৎপিন্ডে ছোট্ট একটি ছিদ্র নিয়ে। বয়স যখন ২৭ বছর, ডাক্তার জানিয়ে দেন আর মাত্র বছরদুয়েক বাঁচবেন তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দৃঢ়চেতা মধুবালা বেঁচে ছিলেন আরও নয়টি বছর। ভারতীয় কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে চিরবিদায় নেন। মধুবালা জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

 

মমতাজ থেকে মধুবালা

চলচ্চিত্রে পা রাখার আগে তাঁর নাম ছিল মমতাজ জাহান বেগম দেহলভি। ১৯৪২ সালে ‘বসন্ত’ চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু। পরে আরও কয়েকটি ছবিতে শিশুশিল্পী। সে সময় অভিনেত্রী দেবিকা রানি শিশু মমতাজ জাহানের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মধুবালা’।

পরবর্তীতে এ নামেই জনপ্রিয়তা শুরু। এর পরের গল্পটা ১৯৪৯ সালের। বোম্বে টকিজ স্টুডিওর ব্যানারে নির্মিত হয় ‘মহল’ চলচ্চিত্র। এতে মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান মধুবালা। সে বছর ভারতে বক্স অফিসের সেরা আয়ের তিনটি ছবির একটি ছিল মহল। এ ছবির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি অভিনয় করেন ‘দুলারি’, ‘বেকসুর’, ‘তারানা’, ‘বাদল’ নামে সে সময়ের উল্লেখযোগ্য সফল ছবিতে।

 

যে কারণে অভিনয়ে আসা

মধুবালা একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা পাকিস্তানের পেশোয়ারের টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁর চাকরি চলে যাওয়ায় সংসারের অভাব দূর করতে মাত্র ৯ বছর বয়সে অভিনয়ে নামেন মধুবালা। তাঁর পরিবার আরও অসহায়ত্বের মাঝে পড়ে যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই তাঁর পাঁচ ভাইবোন মারা যায়। এরপর ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাই ডকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারিয়ে যায় তাঁদের ছোট্ট ঘরটিও। পরিবারের এমন দুর্দশার মধ্যে একমাত্র আশার আলো ছিলেন মমতাজ জাহান। তিনি ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রধান অর্থ উপার্জনকারী। নিজে পরিশ্রম করে মা এবং চার বোনের অন্ন সংস্থান করেছিলেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ১৯৪৭ সালে তিনি ১৪ বছর বয়সে ‘নীল কমল’ সিনেমার প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৬০ সালের অভিনয় জীবনে ৭০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মধুবালা। এ অভিনেত্রীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘অমর’, ‘আরমান’, ‘মুঘল-ই-আজম’, ‘বারসাত কি রাত’, ‘তারানা’ ‘পাসপোর্ট’, ‘দুলারি’, ‘বেকসুর’ ইত্যাদি।

 

হলিউডের চলচ্চিত্রে আমন্ত্রণ

পঞ্চাশ দশকে মধুবালা ছিলেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ও সফল অভিনেত্রী। কেবল নিজ দেশে নয়, হলিউডের মনোযোগও আকর্ষণ করেন এ অনিন্দ্য হাসির অধিকারিণী। আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘থিয়েটার আর্টস’-এর ১৯৫২ সালের আগস্ট ইস্যুতে মধুবালাকে নিয়ে যে ফিচারটি লেখা হয়, তার শিরোনাম দেওয়া হয় ‘দ্য বিগেস্ট স্টার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-অ্যান্ড শি ইজ নট ইন বেভারলি হিলস’। অস্কারজয়ী আমেরিকান নির্মাতা ফ্রাঙ্ক কাপ্রা চেয়েছিলেন মধুবালাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। কিন্তু হলিউডের সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন তাঁর বাবা আতাউল্লাহ।

 

মধুবালার যত প্রেম

মধুবালার জীবনে প্রেমের তরী ভিড়িয়েছিলেন অনেক পুরুষ। তার মধ্যে অভিনেতা দিলীপ কুমারের নাম বোধহয় সবচেয়ে বেশিবার এসেছে। এ জুটির প্রথম দেখা হয় ‘জোয়ার ভাটা’ ছবির সেটে, ১৯৪৪ সালে। ১৯৫১ সালে দিলীপ কুমারের সঙ্গে ‘তারানা’ ছবিতে অভিনয়ের সময় তাঁরা একে অপরের প্রেমে পড়েন। শুটিং চলাকালীন এক দিন মধুবালা তাঁর হেয়ার ড্রেসারকে একটি লাল গোলাপ ও উর্দুতে লেখা চিরকুট দিলীপ কুমারের কাছে পাঠান এবং তাঁকে ভালোবাসলে ফুলটি গ্রহণ করতে বলেন। দিলীপ কুমার মুগ্ধ হয়ে ফুলটি গ্রহণ করেন। বাস্তবে এ জুটির সম্পর্ক ছিল পাঁচ বছর। বিয়ে পর্যন্ত না গেলেও এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হয়েছিল তাঁদের। বিয়ের জন্য দিলীপ কুমার নাকি মধুবালাকে দুটো শর্ত দিয়েছিলেন। এক. বিয়ের পর নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না, দুই. অভিনয় ছাড়তে হবে। পর্দা জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে পারলেও পরিবার ছাড়তে রাজি ছিলেন না মধুবালা। এরপরই ভেঙে যায় তাঁদের সম্পর্ক। তবে এ অভিনেত্রীর বোন জানান, একটি কোর্ট কেসের জন্য সম্পর্ক ভাঙে দিলীপ-মধুবালার।

 

ফের দিলীপের কাছাকাছি

দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিল কালজয়ী হিন্দি সিনেমা ‘মুঘল-ই-আজম’। তাঁদের সম্পর্কের ভাঙনের সুর যখন ছড়াতে শুরু করেছে, তখন পরিচালক কে আসিফ তাঁদের কাছে আসেন এ সিনেমা নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁদের বাস্তব জীবনে মন দেওয়া-নেওয়ার রসায়ন যাতে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে রুপালি পর্দায়। ৯ বছর ধরে নির্মিত হওয়া এ সিনেমাটি সাক্ষী হয় আরও বেশি কিছুর। দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তব জীবনের তুমুল প্রেম, সে প্রেমে ভাঙনের সুর, এরপর বেদনা-বিধুর বিচ্ছেদ জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে। এ সিনেমার নির্মাণকালে এমন অনেক সময় গেছে যখন তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে কথাও বলতেন না। তবু ক্ষতবিক্ষত হৃদয় চেপে রেখে সিনেমার কাজটি তাঁরা করেছিলেন নিজেদের সবটুকু দরদ দিয়ে, উপহার দিয়েছেন নিজেদের সেরা অভিনয়। আর এর ফলে সিনেমাটি কেবল তাঁদের ক্যারিয়ার সেরা সিনেমাই নয়, গোটা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসেই একটি মাইলফলক হয়ে আছে। ‘মুঘল-ই-আজম’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে।

 

ভুট্টোর সঙ্গে প্রেম

অপরূপা সুন্দরী মধুবালার জীবনে প্রেমিকদের তালিকায় ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। দেশভাগ হওয়ার আগে ভারতে প্রচুর সম্পত্তি ছিল ভুট্টোর। ১৯৫৮ সালে ভুট্টো যখন পাকিস্তানের মন্ত্রী হন তখনই তিনি ভারতে যান। সেই সূত্রেই অনিন্দ্যসুন্দরী সুপারস্টার অভিনেত্রী মধুবালার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। মধুবালা তখন ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবির শুটিং করছেন। মাঝে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছে দিলীপ কুমারের সঙ্গে। মর্মাহত মধুবালার মন তখন নতুন কাউকে খুঁজে পেতে চাইছে। সেই সময় কানাঘুষা শোনা যায়, পাকিস্তানের নবম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকেই নাকি খুঁজে নিয়েছিলেন মধুবালা! শোনা যায়, আনারকলির ঝলক দেখতে ভুট্টো প্রায়ই হাজির হতেন ‘মুঘল-ই-আজম’-এর সেটে। ভুট্টোর সঙ্গে মধুবালার এ সম্পর্ক খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অনেকের মতে, সম্ভবত ভুট্টো বুঝে গিয়েছিলেন তাঁদের এ সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই; কারণ মধুবালার জন্য তিনি শুধুই একটি ভরসার কাঁধ হতে পারেন। জীবনসঙ্গী হওয়ার মতো তাঁদের সম্পর্ক নেই। আসলে তখনো মধুবালা দিলীপ কুমারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। প্রেম ব্যর্থ হওয়ার ব্যথা তিনি কোনো দিনই ভুলতে পারেননি। এখানেই শেষ হয় মধুবালা-ভুট্টো সম্পর্কের রহস্যময় প্রেম কাহিনি।

 

কিশোর কুমারের সঙ্গে বিয়ে

দিলীপ কুমার আর ভুট্টোর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সমাধি রচনার পর ১৯৬০ সালে মধুবালা বিয়ে করেন কিশোর কুমারকে। মধুবালাকে নিয়ে তাঁর বোনের লেখা জীবনীতে জানা যায়, কিশোর কুমারকে বিয়ে করলেও তিনি দিলীপ কুমারকেই ভালোবাসতেন। এমনকি দিলীপ কুমারকে দেখানোর জন্যই কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন তিনি।

 

যত অর্জন

১৯৫২ সালে আমেরিকার বিখ্যাত থিয়েটার আর্টস পত্রিকা মধুবালাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা’ বলে সম্মানিত করে। ২০০৮ সালে এই অভিনেত্রীকে নিয়ে ভারতের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সেরা সুন্দরী হিসেবে তাঁকে এক বাক্যে মেনে নেয় সবাই। শুধু অসামান্য রূপই নয়, অভিনয় প্রতিভার জোরে পঞ্চাশ দশকে নার্গিস, মীনা কুমারীদের ছাপিয়ে হিন্দি সিনেমায় নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮-৬০ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি আরোহণ করেন যশ ও খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু এড়াতে পারেননি নিষ্ঠুর নিয়তিকে। সত্য হয়েছিল সে দরবেশের কথাই, যিনি খুব ছোটবেলায় তাঁকে দেখে বলেছিলেন ‘এ মেয়ে অনেক খ্যাতি লাভ করবে, কিন্তু সুখী হতে পারবে না’।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর