শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পোস্টার বয় থেকে সফল অভিনেতা-নির্মাতা

পোস্টার বয় থেকে সফল অভিনেতা-নির্মাতা

সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্ত-কবরী

১৯৬৫ সাল। ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয় বাংলাদেশের এক চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ (১৯৬৪)। যা নির্মাণ করেন সুভাষ দত্ত নামের এক উদীয়মান কমেডি অভিনেতা। এটি তাঁর নির্মিত প্রথম সিনেমা। এর আগে তিনি ছিলেন পোস্টার আঁকিয়ে। ১৯৫৩ সাল থেকে পোস্টার আঁকার কাজ শুরু করেন তিনি।  তারপর একসময় হলেন নামকরা অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রাথমিক জীবন

১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন পটলা। সুভাষ দত্তের ডাকনাম ছিল পটলা। তাঁর গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। তবে বেড়ে উঠেছিলেন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজ বাড়িতে। সিনেমার ভূত যখন মাথায় চেপে বসল, তখনই ছুট দিলেন ভারতের সিনেমার শহর মুম্বাইয়ে। জীবিকার তাগিদে মাত্র ৩০ টাকা মাসিক বেতনে সেখানে একটি সিনেমা পরিবেশনার স্টুডিওতে কাজ নেন তিনি। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে যুক্ত হন পোস্টার ছাপা প্রতিষ্ঠান এভারগ্রিনে। চমৎকার পোস্টার আঁকতে পারতেন। তাঁর এই প্রতিভা তাঁকে বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)-এর পোস্টারের কাজ করেছেন তিনি। চমৎকার ডিজাইন করে প্রতিভার ছাপ রাখার সূচনা সেই থেকেই। এরপর কাজ করেন ‘মাটির পাহাড়’ (১৯৫৯) সিনেমার আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে। সুভাষ দত্ত নিজেকে চলচ্চিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত করেন ১৯৫৯ সালে। পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন একটি কমেডি চরিত্রে। তাঁর অভিনীত সিনেমা ‘হারানো দিন’ (১৯৬১) দারুণ ব্যবসাসফল হয়। এটি একটি সিনেমা হলে টানা পঁচিশ সপ্তাহ প্রদর্শনের রেকর্ড গড়ে।

 

সিনেমা নির্মাণে

একসময় সিনেমা নির্মাণে হাত দেন তিনি। ১৯৬৩ সালের মে মাসে কবরীকে নিয়ে শুরু করেন সিনেমা নির্মাণের কাজ। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘সুতরাং’। প্রশংসিত হন আন্তর্জাতিক মহলে। লাভ করেন ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পুরস্কার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই প্রতিভাধর নির্মাতাকে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘আবির্ভাব’। ১৯৭০ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে। এটি তাঁরই পরিচালিত সিনেমা।

 

সেরা কাজ ১৯৭২ সালে

তাঁর সেরা কাজটি তিনি করেন ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মাণ করেন ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। যেটি গৎবাঁধা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা থেকে বেশ আলাদা। মুক্তিযুদ্ধকেই উপজীব্য করেছেন তিনি। তবে উপস্থাপন এবং নির্মাণশৈলী ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের পুনর্বাসনের কাজ সাহসের সঙ্গে করে দেখানোর তাগিদ ছিল সিনেমাটিতে। 

 

আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণ

 আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর  তৈলচিত্র’ অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন (১৯৭৭)। জাতীয় পুরস্কারে এই সিনেমা সেরা পাঁচটি পুরস্কার জিতে নেয়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন এবং ববিতা। এটি ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত প্রথম ছবি। সুভাষ দত্তই তাঁকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। এ ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের আরেকটি হলো- ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’ অবলম্বনে সিনেমা ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮)।

 

আরও যত অমর সৃষ্টি

তিনি নির্মাতা হিসেবে নিজেকে বারে বারে ভেঙেছেন। তাঁর আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো- ‘কাগজের নৌকা’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৭), ‘পালাবদল’, ‘আলিঙ্গন’, ‘আকাক্সক্ষা’, ‘সকাল-সন্ধ্যা’, ‘ফুলশয্যা’, ‘সবুজসাথী’, ‘নাজমা’, ‘স্বামী-স্ত্রী। তাঁর নির্মিত সর্বশেষ সিনেমা ‘আমার ছেলে’ (২০০৮)।

 

অভিনেতা হিসেবেও অনবদ্য

নির্মাতা হিসেবে বিখ্যাত হলেও সুভাষ দত্তের অভিনয় জীবনটাও উল্লেখযোগ্য। মঞ্চনাটকের নিবেদিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন বহু সিনেমায়। সুভাষ অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘রাজধানীর বুকে’, ‘হারানো দিন’ ‘সূর্যস্নান’, ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘নতুন সুর’, ‘রূপবান’, ‘মিলন’, ‘নদী ও নারী’, ‘ভাইয়া’, ‘আলিঙ্গন’, ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’, ‘ক্যায়সে কাহু’, ‘আখেরি স্টেশন’, ‘সোনার কাজল’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘সমাধান’ ‘আয়না’ প্রভৃতি।

 

যত জনপ্রিয় তারকা আবিষ্কার

সুভাষ দত্ত যেসব শিল্পীকে চলচ্চিত্রে এনে জনপ্রিয় তারকায় পরিণত করেন তাঁরা হলেন- সুচন্দা (কাগজের নৌকা), কবরী ( সুতরাং), উজ্জল (বিনিময়), ইলিয়াস কাঞ্চন (বসুন্ধরা), শর্মিলী আহমেদ ( আবির্ভাব), খান জয়নুল (সুতরাং), বেবী জামানসহ (সুতরাং) অনেকে।

 

যত সম্মাননা

চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুভাষ দত্ত আন্তর্জাতিক সম্মাননাসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়া ১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব এবং ১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার পুরস্কার। ১৯৬৮ সালে নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র। এ ছাড়াও তিনি ১৯৭৭ সালে ঘোষিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাঁর প্রযোজনা-পরিচালনার ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটির জন্য সেরা পরিচালক ও প্রযোজকসহ এটি মোট পাঁচটি পুরস্কারসহ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।

 

না-ফেরার দেশে

বরেণ্য এই নির্মাতা এবং অভিনেতা ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই কারিগর ভাস্বর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

সর্বশেষ খবর