সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

একজন সফল মানুষের দক্ষ কর্মযজ্ঞ

একজন সফল মানুষের দক্ষ কর্মযজ্ঞ

প্রয়াত গাজী মাজহারুল আনোয়ার। একাধারে যিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি গীতিকার, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক। প্রায় ২০ হাজার গানের  স্রষ্টা ও সর্বকালের সেরা গীতিকারদের একজন। এই গুণী মানুষটির কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রথম গানের স্মৃতি

সুভাষ দত্ত বুকে জড়িয়ে ধরলেন...

জীবদ্দশায় এই সফল গীতিকার তাঁর চলচ্চিত্রের গানে অভিষেক প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, এক দিন সংগীত পরিচালক নাজমুল হুদা আমাকে নিয়ে আরেক সংগীত পরিচালক সত্য সাহার কাছে গেলেন। সত্য দা আমাকে নিয়ে প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্তের কাছে গেলেন। সুভাষ দত্ত তখন ‘সুতরাং’ ছবি বানিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়ে খুবই বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সুভাষ দত্ত আমাকে দেখে সত্য দাকে বললেন, এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে এনেছ। সত্য দা বললেন, দাদা ও গান লিখে, ওকে নিয়ে ট্রাই করে দেখুন না। তিনি বললেন, দূর, আমি সুভাষ দত্ত। আমার ছবির গান ও কীভাবে লিখবে? সত্য দা একটু বিব্রত হয়ে বললেন, দাদা এসেছে যখন একটু চেষ্টা করে দেখুন না। কিছু একটা হতেও পারে। আপনি ছবির গানের একটি সিচুয়েশন দেন। সুভাষ দত্ত অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে শিক্ষক ছাত্রীকে পড়াচ্ছেন এই সিচুয়েশনের ওপর একটি গান লিখতে। এতটুকু বিষয় নিয়ে কি গান লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপরও ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে গানটি তৈরি করে ফেললাম। গানের কথা ছিল, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ’। সত্য সাহা সুর করে সুভাষ দত্তকে গানটি শোনালেন। তিনি গানটি শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোমার চেহারা আর গোঁফ দেখে মনেই হয়নি তোমার মধ্যে ম্যাচুয়িরিটি এসেছে, চমৎকার।

 

২০ হাজার গানের রচয়িতা

দেশাত্মবোধক, আধুনিক, চলচ্চিত্রের অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা হলেন এই সফল ব্যক্তিত্ব। জীবদ্দশায় তিনি বলে গেছেন সবমিলিয়ে ২০ হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। কিন্তু সব গান সংরক্ষণে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের যে ফাঁসির তালিকা তৈরি করেছিল সেই তালিকায় ১৩ নম্বরে তিনি ছিলেন। ফলে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে ফিরে দেখেন বাসায় থাকা তাঁর গানের পান্ডুলিপিগুলো আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখেন সেখানেও গানগুলো নেই। পাক বাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে তাঁর রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে।

 

বিবিসির জরিপে সেরা তিন গান তাঁর

বিবিসি বাংলা জরিপকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান। এগুলো হলো- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ এবং ‘একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়’। অন্যদিকে, জাপান-বাংলাদেশ জরিপে সেরা ২০ গানের মধ্যে প্রথম আটটিও তাঁর রচিত।

 

গান রচনার সূচনা

২০ হাজার গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি ওই বছরই বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে। অবশ্য ১৯৬২-৬৩ সালে যখন তিনি মেডিকেল কলেজে পড়েন। সে সময় লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গান। সেই গানের কথা ছিল এমন- ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। যার সুর করেছিলেন নাজমূল হুদা বাচ্চু ও শিল্পী ছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লিখে ৫০ টাকা আয়ের মাধ্যমে তাঁর পেশাদার গীতিকার জীবন শুরু। আর ১৯৬৭ সালে যুক্ত হন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি দিয়ে চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু গাজী মাজহারুল আনোয়ারের।

 

শুরুতে বাধার পাহাড়

‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটির রেকর্ডিং হলো এফডিসিতে। এই গানটি সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবির। বিকাল থেকে রেকর্ডিং শুরু হলো। শেষ হয় রাত ৩টায়। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সবাই যার যার গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু গাজী মাজহারুলের যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁর পকেট ফাঁকা। কানাকড়িও নেই। দেখলেন ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার সবাইকে সম্মানী দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁকে কিছু দিলেন না। তাঁর কাছে গিয়ে তিনি বললেন, ভাই আমি কিছু পাব না। তিনি রাগান্বিত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ, গান লেখার সুযোগ পেয়েছ এটিই তো অনেক। আবার টাকা কিসের? যাও এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাও।’ তাঁর চোখে-মুখে তখন হতাশার অন্ধকার। চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রু বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে যাচ্ছেন। এফডিসির গেটের কাছে যেতেই দারোয়ান বললেন, ‘কি ব্যাপার এভাবে ভিজছ কেন? জ্বর উঠবে তো।’ তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমার জ্বর উঠুক, অসুখ হোক, আমি মরে যেতে চাই।’ দারোয়ান তাঁকে গেটের পাশে তাঁর রুমে জোর করে নিয়ে বসালেন। তারপর বললেন, ‘এখানে কাজ পেতে হলে লাইন লাগে। মানে জানাশোনা বড় মাপের কারও রেফারেন্স দরকার। এমনি এমনি কিছু হবে না। যাও, ফিরে যাও। আর যদি এখানে আসতেই হয় তাহলে এমনভাবে আসবে যাতে রোদে পুড়তে আর বৃষ্টিতে ভিজতে না হয়। রীতিমতো গাড়ি চড়ে আসবে।’ তাঁর কথায় গাজীর মনে জিদ চেপে গেল। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সেদিন বৃষ্টি ভেজা কপর্দকশূন্য তিনি প্রতিজ্ঞার পথ ধরে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। তখন হিজ মাস্টার ভয়েজ মানে এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ড বের করা হতো। এক দিন এইচএমভিতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘একটি গান দিতে চাই।’ প্রতিষ্ঠানটির মালিক তাঁর প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখালেন না। বললেন অমুক তারিখে আসেন। ওই তারিখে গেলে আবার বলতেন তমুক তারিখে আসেন। এভাবে তিনি যে তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তা বেশ বুঝতে পারছিলেন এবং তাতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। এভাবে ক্যারিয়ারের শুরুতে তাঁকে অনেক বাধার পাহাড় ডিঙাতে হয়েছে।

 

যেভাবে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। তিনি যখন এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছেন তখন দেখলেন ‘মরা মানুষ কাটতে হবে’। এটা সহ্য করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। তিনি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়লেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর মনের টান ছিল। পড়াশোনায় অমনোযোগী ভাব দেখে তাঁর এক সহপাঠী বলল ‘তুমি ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কর।’ মেডিকেল কলেজে নাটক হতো। এরপর নাটকের জন্য গান লিখতেন। প্রথমে একটি গান লিখলেন, ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। ফরিদা ইয়াসমিনের গানটি পছন্দ হলো। তিনি রেডিওতে গানটি গাইলেন। তুমুল জনপ্রিয় হলো। কিন্তু গীতিকার হিসেবে গাজীর নাম প্রচার হলো না। মনে খুব কষ্ট পেলেন। ডাক্তারি পড়া আর হলো না। মগবাজারের একটি ঝুপড়ি ঘরে গিয়ে ওঠলেন। গান  লেখা শুরু করলেন। বাবা জানলেন না তাঁর ছেলে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে গান লিখছে।

 

চলচ্চিত্রকার

১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে গানের মতো চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখা ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও সমান দক্ষতা দেখান তিনি। তাঁর প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘সমাধি’ (১৯৭৫) এবং পরিচালিত প্রথম ছবি ‘প্রন্টু ঘটক’ (১৯৮২)। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১টি।

 

সেরা যত গান

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা অসংখ্য গানের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো- জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হলো, গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, আছেন আমার মোক্তার প্রভৃতি।

 

নির্মিত উল্লেখযোগ্য ছবি

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘দেশ চিত্রকথা’। গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম সমাধি, শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, শ্রদ্ধা, সন্ধি, ক্ষুধা, স্নেহ প্রভৃতি।

 

যত সম্মাননা

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।

 

সর্বশেষ খবর