বহুমাত্রিক প্রতিভায় উজ্জ্বল এক পথিকৃতের নাম খান আতাউর রহমান। সবার কাছে তিনি ‘খান আতা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য এই ব্যক্তি ছিলেন চলচ্চিত্রাভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, বেতার ও টিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক এবং প্রযোজক। এ ছাড়াও একসময় কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ রচনা এবং সাংবাদিকতায়ও নিয়োজিত ছিলেন। এতসব বাহারি কর্মে খান আতা রাঙিয়ে গেছেন বাংলার সংস্কৃতির ভুবন। এই বরেণ্য চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বাই
খান আতা ১৯২৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জিয়ারত হোসেন খান এবং মাতা যোহরা খাতুন। তাঁর মা তাঁকে ‘তারা’ নামে ডাকতেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা জিলা সংগীত প্রতিযোগিতায় খান আতা প্রথম স্থান দখল করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে তিনি পরিবারের এক সদস্যের চোখে পড়ে গেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই মেডিকেল ছেড়ে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবারও তাঁর বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে তিনি সেখানে থাকলেন না। এ বছরই তিনি লন্ডনে ফটোগ্রাফিবিষয়ক বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে যাননি। ১৯৪৯ সালে আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এবারও উদ্দেশ্য ছিল একই। এবার তিনি প্রথমে মুম্বাই যান। মুম্বাই গিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, চলচ্চিত্র জগতের আনাচে-কানাচে গেছেন। এ সময় তিনি জ্যোতি স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান জাল ইরানির শিক্ষানবিশ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।
মুম্বাই থেকে করাচি
১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে চলে আসেন করাচি। করাচি এসে তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান-এ সংবাদপত্র পাঠক হিসেবে। এখানেই প্রতিভাবান বাঙালি ফতেহ লোহানীর সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তখনো চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ কমেনি। যার কারণে তিনি প্রায়ই লাহোর যেতেন। এ সময় তিনি সারঙ্গী বাদক জওহারি খানের কাছ থেকে তালিম নেওয়া শুরু করেন। ১৯৫২ সালে খান আতা একটি পোল্যান্ডীয় জাহাজে করে লন্ডন পাড়ি জমান। ১৯৫৫ সালে লন্ডনে ফিরে এসে থিয়েটার রয়্যাল, ইউনিটি থিয়েটার, আরভিং থিয়েটারে সব স্থানীয় গ্রুপের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। এ সময় তিনি বিবিসির সঙ্গেও কাজ করেছেন।
লন্ডনে এস এম সুলতানের সঙ্গে কাজ
লন্ডনে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে খান আতার সাক্ষাৎ হয়। সুলতানের চিত্রকর্মের উপকরণ জোগানে সাহায্য করেন তিনি। খান আতা চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের সিটি লিটারেরি ইনস্টিটিউটে তিনি থিয়েটার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। পরের বছরই তিনি ইউনেস্কো বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডসে চলে যান।
ঢাকায় ফিরে চলচ্চিত্র জীবন
১৯৫৭-তে খান আতা ঢাকায় এসেই পাকিস্তান অবজারভারে চাকরি নেন। তিনি রেডিওতে গীতিকার, সংগীত পরিচালক, আবৃত্তিকার এবং অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি চিত্রপরিচালক আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’তে মূল ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। এ ছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র জগতে তিনি আনিস নামটি ব্যবহার করতেন। একই বছরে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র ‘এ দেশ তোমার আমার’। এ চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন এহতেশাম। ১৯৬০ সালে জহির রায়হানের সঙ্গে গড়ে তোলেন লিটল সিনে সার্কেল। অভিনেতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ‘কখনো আসেনি’, ‘যে নদী মরুপথে’, ‘সোনার কাজল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সুজন সখী’ এর মতো সফল চলচ্চিত্রে।
যেভাবে নায়ক হলেন
লন্ডন থেকে ফিরেছেন খান আতা। কী করবেন পুরোপুরি ভেবে ওঠেননি। একদিন লন্ডনফেরত শুভার্থীদের আড্ডায় এ জে কারদার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার ছবির নায়ক হবে?’ খান আতা বললেন, ‘চাঁছাছোলা চেহারার লোককে আপনি নায়ক বানাবেন?’ উত্তরে কারদার বললেন, ‘জেলে সম্প্রদায়ের লোক কি কন্দর্পকান্তি হবে নাকি?’ এভাবেই এ জে কারদার পরিচালিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে নায়ক হন খান আতা। আনিস নামে এ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। পরে বেশ কটি ছবিতে নায়ক হলেও একসময় চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও অভিনয় করেন।
নির্মিত ছবি
খান আতার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘অনেক দিনের চেনা’ (১৯৬৩)। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেন ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’। চলচ্চিত্রটি ১৯৬৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে গোল্ডেন প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। এরপর তিনি নির্মাণ করেন সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, জোয়ার ভাটা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’; যার বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ- পরবর্তী বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে প্রমোদ কর ছদ্মনামে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মাণ করেন রোমান্টিক চলচ্চিত্র ‘সুজন সখী’। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হন। ’৮০-এর দশকের নির্মাণ করেন ‘হিসাব নিকাশ’ এবং ‘পরশ পাথর’। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৯৪ সালে তিনি ‘এখনো অনেক রাত’ ছবিটি নির্মাণ করেন। তিনি বাংলার কবি জসীমউদ্দীন, গঙ্গা আমার গঙ্গা, গানের পাখি আব্বাস উদ্দিনসহ বেশকিছু তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন।
সংগীত পরিচালক
খান আতা সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে। ১৯৬২ সালে ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে তিনি উপহার দেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে’ এর মতো গান। গানটিতে কণ্ঠ দেন কলিম শরাফী। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের ‘কাচের দেয়াল’ ছবিতে তিনি নিয়ে আসেন ‘শ্যামল বরণ মেয়েটি’র মতো একটি জনপ্রিয় গান। ‘সূর্যস্নান’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে এবং ‘কাচের দেয়াল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া সংগীত পরিচালক ছিলেন বাহানা, সাগর, আখেরি স্টেশান, মালা প্রভৃতি উর্দু ছবিতে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে তিনি ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ শীর্ষক গানের কথা লিখেন এবং নিজেই কণ্ঠ দেন। ’৭০ এবং ’৮০-এর দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘এ কি সোনার আলোয়’, শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ এর মতো জনপ্রিয় গান। খান আতাউর রহমান প্রায় ৫০০ গানের গীতিকার। ‘এখনো অনেক রাত’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার লাভ করেন।
দেশপ্রেম
ব্যতিক্রমী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটির দেশের প্রতিও ছিল অগাধ ভালোবাসা। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শহীদ মিনার চত্বরে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ ব্যানারে নাটক, গান, আবৃত্তিচর্চা করা হতো মানুষকে স্বাধীনতার প্রতি উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে। অসহযোগ আন্দোলনের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ার সংবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খান আতা ২৫ মার্চ রাত ৯টায় কাকরাইলে তাঁর অফিস সেভেন আর্টস ইউনাইটেডে প্রযোজকদের জরুরি সভা ডেকে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি রাখেন। খান আতাকে নিয়ে অনেক অদ্ভুত কথা শোনা যায়। অনেকে বলেন, খান আতা নাকি রাজাকার ছিলেন। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পৌঁছে দিতেন। শীতের কাপড় এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন সবসময়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এমন কোনো দিন নেই যেদিন খান আতার গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করা হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের ‘এই দেশ এই মাটি’ এবং সুখ-দুঃখ চলচ্চিত্রের ‘এইবার জীবনের জয় হবে’ ও ‘আমাদের বন্দী করে যদি ওরা ভাবে’ গানগুলো। এ ছাড়াও খান আতার আরও অনেক গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হতো। ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে চলে যান।