রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফ্যাশন আইকন সেই জাফর ইকবাল

ফ্যাশন আইকন সেই জাফর ইকবাল

জাফর ইকবাল মানে কালজয়ী অনেক গান আর অভিনয় করা এক প্রিয়মুখ। তবে যে কারণে এই নায়ক তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তা হলো তাঁর নতুন নতুন ফ্যাশন আবিষ্কার। তাঁকে ফ্যাশন আইকনও বলা হয়।  অকালে পরপারে পাড়ি দেওয়া এই অমর নায়ককে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

গাইতে গিয়ে নায়ক

নিজের ব্যান্ড নিয়ে কনসার্টে গাইতে গিয়ে নজরে পড়েন জাফর ইকবাল। ১৯৬৯ সালের কথা। একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে তাঁকে দেখে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ খান আতাউর রহমান মুগ্ধ হন। এরপর ১৯৭০ সালে তার পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে পর্দায় অভিষেক ঘটে জাফর ইকবালের।  চলচ্চিলটি সুপারহিট এবং প্রথম ছবিতেই সফল হন জাফর।

 

ফ্যাশন আইকন

কণ্ঠ, অভিনয়, ফ্যাশন ও স্টাইল মিলিয়ে জাফর ইকবাল ছিলেন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। আশির দশকে তরুণদের ফ্যাশন আইকন ভাবা হতো তাঁকে। একজন অনবদ্য অভিনেতার পাশাপাশি গায়ক ও স্টাইলিশ মানুষ হিসেবে বিস্তৃত তাঁর শিল্পীসত্তার পরিধি। নায়ক-গায়ক জাফর ইকবাল যেন এক চিরসবুজের প্রতীক। তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তার পাল্লা ছিল ভারি। তাঁর কথা বলা, হাঁটা, গিটার বাজানো সবই সব বয়সের মানুষের নজর কেড়েছিল।

 

আদর্শ এলভিস প্রিসলি

জাফর ইকবাল গিটার বাজাতেন ভালো। তাঁর আদর্শ তারকা ছিলেন রক এন রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবালের জন্ম সুরের ভুবনে। গায়কই হওয়ার কথা ছিল তাঁর। ব্যান্ড ছিল তাঁর। অ্যালবামও আছে। রুপালি পর্দায় বিচরণের আগে গিটারবাদক ছিলেন জাফর ইকবাল।

 

ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা

গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে জাফর ইকবাল গঠন করেছিলেন র‌্যাম্বলিং স্টোনস নামের একটি ব্যান্ড।

 

গান না শিখেই গায়ক

তাঁর সাংস্কৃতিক যাত্রা শুরু গান দিয়ে। তবে তিনি কারও কাছে গান শেখেননি। সুরের ভুবনে বেড়ে ওঠায় গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। বড় ভাই অমর সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ ও ছোট বোন কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহর দেখাদেখি নিজেও গাওয়ার চেষ্টা করতেন। ভাইবোনের মতো গানটাকে ভালোবাসতে শেখেন, গাইতে শুরু করেন।  এসএসসি পাস করার আগেই গিটার বাজানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন। স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান থাকলেই গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রিসলির গান গাইতেন তিনি। সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা জাফর ইকবালের আবির্ভাব সংগীতশিল্পী হিসেবে। সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে গিটার বাজাতেন। রবিন ঘোষের সুরে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘পীচ ঢালা পথ’ ছবির ‘পিচঢালা এই পথটাকে ভালোবেসেছি’ গানে গিটার বাজান তিনি। নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ গানটিও তাঁর গাওয়া। দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি আলাউদ্দিন আলির সুর ও সংগীত পরিচালনায় রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানে কণ্ঠ দেন জাফর ইকবাল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’ গানে কণ্ঠ দিয়ে মোহামেডানের পক্ষ নেন তিনি।

বিটিভির সংগীত শিল্পী

বিটিভির ‘আনন্দমেলা’য় বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি নিজের গাওয়া গানগুলো নিয়ে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেন তিনি। বিটিভিতে জাফর ইকবাল পরিবেশন করেন ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারও ঘরণী’। বিটিভির রজতজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’। জাফর ইকবালের অনবদ্য গানের তালিকায় আরও আছে ‘যেভাবেই বাঁচি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের কাছাকাছি’, ‘শেষ করো না, শুরুতেই খেলা, না ভেঙো না’, ‘বিদেশ থেকে দেশে আইলে’। তিনি প্রায় ২০০ গান গেয়েছেন।

 

মুক্তিযোদ্ধা...

জাফর ইকবাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে তিনি  যেমন পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের শোবিজে অভিনয়, গান আর স্টাইল জাদুতে  আবিষ্ট করেছেন গুণমুগ্ধদের।

 

অভিনীত চলচ্চিত্র

জাফর ইকবালের প্রথম অভিনীত ছবি হচ্ছে ‘আপন পর’। তিনি প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

 

শেষ ছবির স্মৃতি...

জাফর ইকবাল বেঁচে থাকতে তাঁর অভিনীত শেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ‘লক্ষ্মীর সংসার’ ছবিটি। এ ছবিতে তাঁর ঠোঁট মেলানো গান ‘আজিমপুর যাব কীভাবে’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবিটি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই জাফর পরপারে চলে যান। মৃত্যুর পর জাফর ইকবালকে আর আজিমপুর খুঁজতে হয়নি। সহজেই সেখানে চলে গেলেন এবং চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন।

 

বিয়ে-সংসার-বিদায়

জাফর ইকবালের স্ত্রীর নাম সোনিয়া। তাঁদের দুই সন্তান ছিল। চিত্র জগতের এক জনপ্রিয় নায়িকাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁকে জীবনে না পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। তাঁর এই বিপর্যয়ের কারণে পারিবারিক জীবনেও শান্তি পাননি। অশান্তির কারণে জাফর ইকবাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মদ পান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তাঁর হার্ট এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল। ঢাকার আজিমপুরে গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে যাওয়া এই জীবন গল্পের নায়ক।

 

চরম অবহেলায় ঘুমিয়ে

মৃত্যুর পর দীর্ঘ ২১ বছর পার হয়ে গেলেও তাঁর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীতে চলচ্চিত্র জগৎ, তাঁর পরিবার বা অন্য কেউ তাঁকে স্মরণ করে না। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো মৃত্যুর পরও অবহেলায় রয়ে গেলেন এই ফ্যাশনেবল ড্যাশিং হিরো। প্রয়াত জাফর ইকবালের শেষ ঠিকানা হয়েছিল ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে তাঁর কবর খুঁজে পাওয়া গেল। কবরস্থানের একজন কেয়ারটেকার শহীদ, যিনি প্রায় ৩৯ বছর ধরে সেখানে কাজ করছেন। তিনি জাফরের কবরের জায়গাটি দেখিয়ে বললেন, জাফর ইকবালের পরিবারের কাউকে কখনো এখানে আসতে বা তাঁর কবরের খোঁজ নিতে দেখিনি। কবরটিকে একটি পরিত্যক্ত জঙ্গলই বলা যায়। নেই কোনো নামফলক।

একটি আম গাছের পাশে জঙ্গলাকীর্ণ স্থান, যেখানে ছোট একটি কাঁঠাল গাছ দাঁড়িয়ে আছে, সেটিকে দেখিয়ে শহীদ জানালেন এটিই সেই নায়কের কবর। এ কবরটির ওপর ইতিমধ্যে ২০-৩০টির মতো কবর পড়েছে। কবরটিতে এখন জাফর ইকবালের বিন্দুমাত্র স্মৃতিচিহ্ন নেই।  এমন একজন জনপ্রিয় নায়ক, গায়ক ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কি কারও কোনো দায়িত্ব ছিল না। মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিটুকু ধরে রাখার প্রয়োজনও কী কেউ অনুভব করলেন না।

সর্বশেষ খবর