শিরোনাম
সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমাদের উত্তম কুমার

আমাদের উত্তম কুমার

নায়করাজ রাজ্জাকের বেদনাবিধুর প্রয়াণ দিবস আজ।  তাঁর চলে যাওয়া মানে দেশীয় চলচ্চিত্রে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হওয়া ও চলচ্চিত্র জগৎ মুরব্বিশূন্য হয়ে পড়া। এ দেশের চলচ্চিত্রের এই মহিরুহের চিরপ্রস্থানে হয়েছেও তাই। ঢাকার চলচ্চিত্র আজ জরাজীর্ণ দশা অতিক্রম করছে। নায়করাজের অনাকাক্সিক্ষত প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

উত্তমের পাশে সমান দাপুটে

টালিগঞ্জের মহানায়ক উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি আর গর্ব। ষাটের দশক পর্যন্ত এ দেশের দর্শক বড় পর্দায় উত্তম কুমার অভিনীত ছবিতে বুঁদ হয়ে থাকত। তাঁর চালচলন, বেশভূষা, কথা বলার ধরন, হেয়ার স্টাইল- সব কিছুই যেন দর্শকদের অনুসরণ আর অনুকরণের বিষয়। মানে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই যেন উত্তম ম্যানিয়ায় ভুগছিল। তখন মহানায়ক বলতে বাঙালি দর্শকের কাছে উত্তম কুমারের বিকল্প আর কিছুই ছিল না। ওই সময়ে সবাই যখন চিরকালের উত্তম বন্দনায় মহামগ্ন ঠিক তখনই ১৯৬৬ সালে এপার বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাণের অবিসংবাদিত কারিগর জহির রায়হান নির্মাণ করলেন চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’। আর সেই চলচ্চিত্রে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখলেন এক নতুন নায়ককে। যার পর্দা উপস্থিতি, অভিনয়শৈলী আর ব্যক্তিত্ব দর্শকদের চোখ আর মনকে নিমিষেই আটকে দিল সেই নতুন নায়কের প্রতি। এক কথায় সুদর্শন আর ব্যক্তিত্বের আধার বলতে যা বোঝায় তিনি হলেন তাই। সেই নবাগত নায়ক হলেন ‘রাজ্জাক’। এপার বাংলার দর্শক খুঁজে পেল আপন চলচ্চিত্রের নতুন ঠিকানা এক নতুন নায়ক। গর্ব করে তারা বলে ওঠল, আমাদের আছে চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত রাজা ‘নায়করাজ রাজ্জাক’। বাংলাদেশে শুরু হলো রাজ্জাক ফোবিয়া। তাঁর মতো আর কোনো নায়কের জন্ম আজও এ দেশে হয়নি। তাই তো প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার প্রয়াত আহমেদ জামান চৌধুরীর মতো একজন পাকা জহুরির চোখ এড়ায়নি রাজ্জাক ক্যারিশমায়। রাজ্জাকের অভিনয়ের মহাগুণে তিনি তাঁকে প্রবাদতুল্য উপাধি দিতে ভুললেন না। রাজ্জাককে অবলীলায় তিনি ‘নায়করাজ’ উপমায় ভূষিত করলেন। দর্শক ও চলচ্চিত্রের মানুষ এই উপাধি সাদরে ও সানন্দে গ্রহণ করলেন। ওপার বাংলার উত্তম কুমারের মতো আমরাও পেয়ে গেলাম কিংবদন্তি নায়ক ‘নায়করাজ রাজ্জাক’কে। অনেকেই অবশ্য রাজ্জাককে উত্তম কুমারের সঙ্গে তুলনা করলেও রাজ্জাক ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। টানা পাঁচ দশক দক্ষ কর্মযজ্ঞ দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভান্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। রাষ্ট্রও তাঁকে দিয়েছে কাজের স্বীকৃতি ও যথাযথ সম্মান। চলচ্চিত্রের এই মহান রাজা পেয়ে গেছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট কোটি কোটি ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেছেন চলচ্চিত্রের এই রাজাধিরাজ। আজ তাঁর বেদনাবিদূর প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

জন্ম ও ঢাকায় আসা

১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম নেওয়া আবদুর রাজ্জাক স্কুল জীবনেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী আর তিন মাস বয়সের পুত্র বাপ্পারাজকে নিয়ে একজন শরণার্থী হিসেবে ঢাকায় আসেন রাজ্জাক। শুরু হয় তাঁর জীবনযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে জয়ী হতে চলচ্চিত্রকেই বেছে নেন তিনি। কাজের প্রতি আন্তরিকতা আর মমত্ববোধ সহজেই তাঁকে সহকারী পরিচালক আর সহশিল্পী থেকে রাজার আসনে বসিয়ে দেয়। ১৯৬৮ সালে নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি জহির রায়হান নির্মিত ‘বেহুলা’ মুক্তি পায়। তাঁর অভিনয় কুশলতায় চারদিকে তখন সাজ সাজ রব। পাঁচ দশক ধরে নিরবছিন্নভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে চলচ্চিত্রে পথচলা নায়করাজের। কাজের প্রতি নিষ্ঠা একজন সাধারণ মানুষকে যে অসাধারণ করে তুলতে পারে তার প্রমাণ রাজ্জাক। তিনি যথার্থ চলচ্চিত্রের রাজা। পৃথিবীতে নায়করাজ একজনই হয়েছেন, দ্বিতীয় কেউ আর হতে পারবে না। চলচ্চিত্রের রাজা হয়েও নায়করাজের মধ্যে অহংবোধ ছিল না। অহংকারকে তিনি কখনো পছন্দ করতেন না। নায়করাজের কথায় প্রতিষ্ঠা আর ভালোবাসা পেতে হলে বিনয়ী হতে হয়। সত্যিই তিনি অসাধারণ একজন বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তাঁর কথাবার্তা আর আচার-আচরণে সদা এই বিনয়ী ভাব ফুটে উঠত। কাউকে কষ্ট দিয়ে তিনি কথা বলেছেন এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। প্রয়াণের আগে মিডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর মহানুভবতার কথাই আবার ফুটে উঠেছিল। সাক্ষাৎকারে নায়করাজ বলেছিলেন, এই জীবনে আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই, সৃষ্টিকর্তা আমাকে সম্মান, ভালোবাসা এবং সুন্দর একটি সংসার দিয়েছেন। আমার জীবন সুখের পূর্ণতায় ভরা। এখন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সম্মান নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারলেই এ জীবন সার্থক হবে। তিনি বলেছিলেন, আমি জীবনটাকে সহজভাবেই উপভোগ করি। আমি মানুষ রাজ্জাক, এটাই আমার বড় পরিচয়। যখন অভিনয় করি তখন শিল্পী। এর বাইরে সাধারণ মানুষ। আমি কখনো কারও সঙ্গে অহংকার দেখাইনি। একটি বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। নায়করাজের আত্মতৃপ্তির কথা শুনে তাঁরই নির্মিত ও অভিনীত ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল। ‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন, কী আদর স্নেহ-ভালোবাসায় জড়ানো মায়ার বাঁধন...’।

 

নিজের জীবন নিয়ে বলা কথা

নিজের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন সম্পর্কে নায়করাজের কথা ছিল- জীবনে সফলতার জন্য অনেক ধৈর্য আর ত্যাগের দরকার। কেউ যখন কোনো একটা অবস্থানে চলে যায়, তখন নিজেকে মানিয়ে চলতে খুব কম মানুষই পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সহযোগিতা করেছেন। ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও পপ্রন্ড  ইচ্ছাশক্তির কারণেই চলচ্চিত্রে এসেছিলাম। প্রতিষ্ঠাও পেয়েছি। আমি মনে করি, ব্যক্তি রাজ্জাক একবারেই সাধারণ। আর শিল্পী রাজ্জাক মানে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের পাত্র। যারা সময়টাকে জয় করতে পারে, তারা জীবনে অনেক কিছুই করতে পারে। আমার স্বপ্ন ছিল, যে করেই হোক আমাকে শিল্পী হতে হবে। তার জন্য যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা আমি করব। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা ও দর্শক আমাকে সহযোগিতা করেছেন। যে কোনো মানুষের জীবনে একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। আমি কী হতে চাই? দোটানা থাকা যাবে না, আত্মপ্রত্যয়ী এবং বাস্তবতার আলোকে হতে হবে।

 

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল

ছেলেবেলায় স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার। কিন্তু কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজা চলার সময় মঞ্চনাটকে অভিনয় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। টালিগঞ্জের ফিল্মপাড়ার কাছেই ছিল রাজ্জাকের পৈতৃক বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাসদের দেখে দেখে বড় হয়েছেন। তাই রক্তে ঢুকে যায় অভিনয়ের নেশা। ভারতে টুকটাক অভিনয় করলেও তার শুরুটা ঢাকায়।

 

এক নজরে রাজ্জাক

প্রকৃত নাম : আবদুর রাজ্জাক।

বাবা-মা : আকবর হোসেন ও নিসারুন্নেসা।

জন্ম : ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। কলকাতার টালিগঞ্জে।

মৃত্যু : ২১ আগস্ট, ২০১৭ সাল।

বিয়ে : ১৯ বছর বয়সে, ১৯৬২ সালে। বিয়ে করেন খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীকে।

সন্তান : তিন পুত্র ও দুই কন্যা।

বাংলাদেশে আগমন : ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন।

অভিনয় জীবন : স্কুলে পড়ার সময় ‘বিদ্রোহী’ নাটকে, কলেজ জীবনে ‘রতন লাল বাঙালি’ ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনয়। ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্মালয়ে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার ‘পংকতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ঢাকার ছবিতে অভিনয়।

প্রথম ছবি [নায়ক] : ১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’।

শেষ অভিনীত ছবি : বাপ্পারাজের ‘কার্তুজ’ ২০১৪ সাল।

সর্বশেষ খবর