বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘পৃথিবীটা মানুষের দুই দিনেরই এক জেল’

‘পৃথিবীটা মানুষের দুই দিনেরই এক জেল’

‘আসবার কালে আসলাম একা, যাবার কালে যাব একা, মাঝে মাঝে মনরে বলি চক্ষু মেইলা কি দেখলা, মন বলে দুনিয়াদারি ঝকমারি দুই দিনেরই এক জেল’... নায়ক-প্রযোজক মান্না অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘মনের সাথে যুদ্ধ’র জনপ্রিয় গান এটি। কাকতালীয়ভাবে ছবিটি নির্মাণের অল্প সময়ের মধ্যেই মান্নার জীবনে এই গানটির কথাগুলো দুঃখজনকভাবে সত্যি হয়ে গেল। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই ধরাধাম ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন জীবন গল্পের এই নায়ক। এই অকাল প্রয়াত নায়ককে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নায়কই হতে চেয়েছিলেন...

ছোটবেলা থেকে সিনেমার প্রতি তাঁর ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় প্রচুর সিনেমা দেখতেন। টাঙ্গাইলের এস এম আসলাম তালুকদার নামের সেই কিশোর হয়তো তখনো জানতেন না যে, তিনিই একদিন হয়ে উঠবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয় নায়ক মান্না। নায়করাজ রাজ্জাকের সিনেমা ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। রাজ্জাকের ছবি সিনেমা হলে এলে আর কথা নেই। ছুটে যেতেন দেখতে। নায়করাজ ছিলেন মান্নার জীবনের আদর্শ। স্বপ্ন দেখতেন তিনিও একদিন অভিনয় করবেন। অনেকের ইচ্ছা থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার; কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল নায়ক হওয়ার। একদিন বলাকা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ বিজ্ঞাপন। তারপর টিভি আর পত্রিকায় দেখে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ইন্টারভিউ দেন। সুযোগও পেয়ে যান। ১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন আসলাম তালুকদার। এ কার্যক্রমে সুযোগ পেয়েই কিন্তু আসলাম থেকে নায়ক মান্না হতে পারেননি তিনি। এর জন্য অনেক ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এফডিসির অফিসপাড়ায় ঘোরাঘুরি আর নিয়মিত পরিচালকদের কাছে ধরনা দিতে হতো। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু, সেই রাজ্জাকই একসময় তাঁকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। ১৯৮৬ সালে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ‘তওবা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ ঘটে মান্নার। আর এভাবেই শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে এস এম আসলাম তালুকদার নাম বদলিয়ে হয়ে ওঠেন মান্না।

 

শুরুতে অ্যান্টি হিরো...

শুরুতে একের পর এক অ্যান্টি হিরো হিসেবে অভিনয় করেছেন। সে সময় তেমন কোনো সাফল্য আসেনি। আশির দশকে মান্না যখন ছবিতে অভিনয় শুরু করেন, সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, জসীম, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনদের নায়ক হিসেবে বেশ দাপট। সেই দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও ‘তওবা’, ‘পাগলী’, ‘ছেলে কার’, ‘নিষ্পাপ’, ‘পালকি’, ‘দুঃখিনী মা’, ‘বাদশা ভাই’-এর মতো ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন মান্না। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ছবির কোনোটিতেই মান্না প্রধান নায়ক ছিলেন না। তাই সাফল্যের ভাগিদার খুব একটা হতে পারতেন না। মান্না অভিনীত প্রথম ছবি ‘তওবা’ হলেও প্রথম ছবি হিসেবে যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল তার নাম ‘পাগলী’।

 

অতঃপর নায়ক হলেন...

১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাশেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এ ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হওয়ার কারণে একের পর এক ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান মান্না। এরপর কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ ছবির কারণে তাঁর একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন মান্না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’ ছবির পর একটু ধীরে এগোতে থাকেন মান্না। সে সময় তাঁকে নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়। সবাই তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকরাও তাঁর কাছে নির্ভরতা খোঁজে পান। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নাঈম-শাবনাজ, সালমান-শাবনূর, সানী-মৌসুমী জুটি বেশ সফল। তাঁদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যান মান্না। মনতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াৎ, নুর হোসেন বলাই, নাদিম মাহমুদ, এম এ মালেক, এফ আই মানিক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এ জে রানা, বেলাল আহমেদের মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে মান্না নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন।

 

অভিনয়ে নতুন স্টাইল...

ভিন্নধারার হাসি-কান্নার অভিনয়, অ্যাকশন, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন মান্না। এরপর থেকেই বহু অভিনেতার অনুকরণীয় হয়ে উঠেন তিনি। তাঁর অভিনীত এমন কিছু ছবি আছে যার জন্য তিনি চিরদিনের জন্য দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল, যখন ছবিতে শুধু মান্না আছেন- এ কারণেই দর্শক হলে ছুটে গেছেন, তাঁর কারণেই ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর ছবিতেও মান্না ছিলেন অনবদ্য। এমনও বছর গেছে যেখানে সেরা ১০টি ব্যবসাসফল ছবির নাম খুঁজলে দেখা যেত সবকটিই মান্নার ছবি।

 

প্রযোজনায়...

১৯৯৭ সালে নায়ক থেকে প্রযোজনায়ও আসেন মান্না। মান্নার প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘লুটতরাজ’ সুপারহিট ব্যবসা করে। এরপর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শুরু হয় মান্না-অধ্যায়। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে মান্নার ছবি। বেশির ভাগ ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সফলতাও পায়। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-বিষয়ক নানা কর্মকান্ডে মান্নার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যে সব সিনেমা প্রযোজনা করেছেন, প্রতিটি সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছিল। সিনেমাগুলো হচ্ছে- ‘লুটতরাজ’, ‘লাল বাদশা’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘দুই বধূ এক স্বামী’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’, ‘মান্না ভাই’ ও ‘পিতা মাতার আমানত’। ১৯৯৭ সালে প্রযোজকের খাতায় নাম লেখান মান্না। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্র’।

 

মান্নার যত নায়িকা...

মান্না একমাত্র নায়ক যিনি শতাধিক পরিচালক ও ৬১ জন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে এটি রেকর্ডের শামিল। আশির দশকে সুনেত্রা, রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস, শাহনাজ, নিপা মোনালিসা থেকে শুরু করে চম্পা, দিতি, কবিতার মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনি মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, অপু, নিপুণ, একার সঙ্গেও তাঁর ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে।

 

পরিবারই ছিল প্রাণ...

নায়ক মান্নাকে সবাই পর্দায় দেখেছেন, তাঁর জনপ্রিয়তা, নায়কোচিত ভঙ্গি উপভোগ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে মান্না কেমন ছিলেন? জানা যায়, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও মানুষ হিসেবে মান্না অতি নমনীয় এবং বিনয়ী ছিলেন। সহকর্মী, সিনে-কুশলী কিংবা ভক্ত থেকে গণমাধ্যমকর্মী, সবার সঙ্গেই হাসিখুশি মিশতেন তিনি। জনপ্রিয়তার সুবাদে নায়ক মান্নার ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। সেই ব্যস্ততায় পরিবারকে কখনো বঞ্চিত করেননি। কাজের বাইরে প্রায় পুরোটা সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতেন। দেশ-বিদেশে ঘুরতে যেতেন স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে। সে সব মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি হয়ে আছে আজও। মান্নার পুত্র সিয়াম ইলতেমাশের সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গেল তাঁদের পারিবারিক মুহূর্তের কিছু অদেখা স্থিরচিত্র। যেগুলো দেখলে সহজেই আঁচ করা যায়, মান্নার কাছে পরিবার কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

 

সিনেমায় সবাই স্বার্থ নিয়ে চলে : মান্না

সিনেমার মানুষ ছিলেন মান্না; কিন্তু এটুকু বিশ্বাস করতেন, এই জগতে কেউ কারও বন্ধু হয় না। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন, ‘ফিল্মে বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নেই। আমার কোনো বন্ধু নেই এখানে। চলচ্চিত্রের কেউ যদি বুকে হাত দিয়ে বলেন, আমরা সবাই এক পরিবার, তবে সেটা হবে সবচেয়ে বড় মিথ্যা। কারণ এখানে সবাই স্বার্থ নিয়ে চলেন।’ এই বাস্তবিক বিশ্বাসের কারণে মান্না পরিবারকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বলা জরুরি, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই শেলীকে বিয়ে করেন মান্না। তাঁদের একমাত্র পুত্র সিয়াম ইলতেমাশ পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

 

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী

মান্নার সিনেমা মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি দর্শক এবং প্রযোজকের পকেটে লাভের টাকা। তাঁর সিনেমায় বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে বারবার। বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি সবার মন জয় করেন। তাই তিনি ছিলেন আপামর মানুষের প্রিয় নায়ক।

 

জাতীয় পুরস্কার

‘বীর সৈনিক’ (২০০৩) সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন মান্না। তাঁর অভিনীত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই সিনেমাটির জন্য তিনি ১৯৯৯ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পান।

 

যত জনপ্রিয় ছবি

দাঙ্গা, লুটতরাজ, তেজী, আম্মাজান, আব্বাজান, বীর সৈনিক, শান্ত কেন মাস্তান, সুলতান, বিগবস, মান্না ভাই, জনতার বাদশা, রাজপথের রাজা, এতিম রাজা, ভিলেন, নায়ক, জুম্মান কসাই, আমি জেল থেকে বলছি, কাবুলিওয়ালা, সিপাহী, যন্ত্রণা, পাগলী, ত্রাস, লাল বাদশা, রুটি, অন্ধ আইন, স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ, দুই বধূ এক স্বামী, ফায়ার, লাঠি, খবরদার, অবুঝ শিশু, মায়ের মর্যাদা, মা-বাবার স্বপ্ন, হৃদয় থেকে পাওয়া, মনের সাথে যুদ্ধ প্রভৃতি।

সর্বশেষ খবর