মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে ঢাকার ছবির সাফল্য

আলাউদ্দীন মাজিদ

দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে ঢাকার ছবির সাফল্য

দেবী

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য সুখবর তৈরি হয়েছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে ঢাকার ছবি সাড়া জাগাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই হলিউড ও বলিউডের ছবি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে আসছিল। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের ছবি। গত কয়েক বছর ধরে বিদেশে বাংলাদেশের ছবির জয়গান চলছে।

বিশ্ববাজারে বাংলা ছবি মুক্তির সফলতার পেছনে যে পরিবেশনা সংস্থাটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে সেটি হলো ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’। আমেরিকা ও কানাডায় বেশ কিছু বাংলা ছবি মুক্তি দিয়ে সফল হয়েছে সংস্থাটি।  ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’র বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈকত সালাহউদ্দিন জানান, আমরা আমদানি-রপ্তানির আওতায় নয়, সরাসরি পরিবেশক হিসেবে বিদেশে ছবি মুক্তি দিয়ে আসছি। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর আমাদের পরিবেশিত ২১ নম্বর ছবি হিসেবে কানাডা ও আমেরিকায় ‘অন্তর্জাল’ ছবিটি মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সৈকত সালাহউদ্দিন আরও জানান, ২০১৬ সালে ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’ প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান তরুণ মো. অলিউল্লাহ সজীব। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি হলিউড ও বলিউডের মতো বাংলাদেশের ছবি বিদেশে পরিবেশনা শুরু করেন। একসময় বিদেশে সিনেমা হল ভাড়া করে বাংলদেশের ছবি মুক্তি দেওয়া হতো। কিন্তু পরে স্বপ্ন এসে পরিবেশক হিসেবে বাংলাদেশি ছবি বিদেশে মুক্তি দেওয়া এবং সাফল্য পেতে শুরু করে। স্বপ্নের মাধ্যমে অলিউল্লাহ সজীব সর্বপ্রথম ২০১৬ সালে কানাডার একটি সিনেমা হলে অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ ছবিটি মুক্তি দেন। এরপর কানাডা ও আমেরিকার পাশাপাশি তিনি মধ্যপ্রাচ্যেও বাংলদেশের ছবি মুক্তি দিতে শুরু করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই রিগাল, সিনেমার্ক, সিনেপ্লেক্স, ভক্সের মতো বিশ্বখ্যাত চেইনে মুক্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের ছবি। ‘স্বপ্ন’ পরিবেশিত ছবিগুলো বিদেশে বড় মাপের সাফল্য পেতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত এই পরিবেশনা সংস্থার পরিবেশিত যে সব ছবি বিদেশে বড় মাপের সাফল্য পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘দেবী’, ‘হাওয়া’ ও ‘প্রিয়তমা’। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ ছবিটি। এর মোট আয় হচ্ছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। বিদেশে ‘স্বপ্ন’ পরিবেশিত সবশেষ ছবি হলো ‘এমআর নাইন’। যা গত সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে। এটি কানাডা ও আমেরিকার ১৫১টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে এত বেশিসংখ্যক সিনেমা হলে বাংলাদেশের ছবি মুক্তির ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে একটি অনন্য রেকর্ড। উত্তর আমেরিকার বায়োস্কোপ, অস্ট্রেলিয়ার ঈগল এন্টারটেইনমেন্ট, পথ প্রোডাকশন ও দেশি ইভেন্টসের মতো কিছু সংস্থাও বিদেশে নিয়মিত ছবি মুক্তি দিচ্ছে। এই মুহূর্তে সাত দেশে চলছে বাংলা ছবি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালিতে চলছে হিমেল আশরাফের ‘প্রিয়তমা’। ভারত, যুক্তরাষ্ট্রে চলছে রায়হান রাফীর ‘সুড়ঙ্গ’। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাত দেশে আরবি সাবটাইটেলে চলছে ‘সুড়ঙ্গ’, জানিয়েছে বায়োস্কোপ ফিল্মস। অস্ট্রেলিয়ায় চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় অনেক দিন ধরেই নিয়মিত বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলোতে এত বাঙালি থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত বাংলা ছবি মুক্তি পায়নি। সেই আফসোস ঘুচিয়েছে সেখানকার প্রবাসী বাঙালিরা। ফ্রান্সের প্যারিস এবং ইতালির ভেনিসে প্রদর্শিত হচ্ছে ‘প্রিয়তমা’। এই দুই শহরে ছবিটি দারুণ সাড়া ফেলেছে, জানিয়েছেন এ ছবির পরিচালক হিমেল আশরাফ। প্যারিস ও ভেনিসে দর্শকের চাপে অফিশিয়ালি ছবিটি প্রদর্শিত হয়। ফ্রান্স, ইতালিতে ‘প্রিয়তমা’ পরিবেশন করছেন জাহিদ হাসান অভি। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম দর্শক আসবে কি না! আন-অফিশিয়ালি ‘প্রিয়তমা’ মুক্তির পর সেই সন্দেহ কেটে গেছে। প্যারিসে অগ্রিম তিন দিনের টিকিট সোল্ড আউট হয়। ফ্রান্স ও ইতালির অন্য শহরে এবং পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরেও প্রিয়তমা।’ এদিকে বঙ্গজ ফিল্মসের আয়োজনে ৭ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্য ও শহরে মুক্তি পায় ‘সুড়ঙ্গ’। দর্শক আগ্রহে তিন সপ্তাহ সেখানে চলে ছবিটি। ৫ আগস্ট অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তি পেয়েছে ‘প্রিয়তমা’। ঈগল এন্টারটেইনমেন্টের কর্ণধার সাব্বির চৌধুরী বলেন, এরই মধ্যে যত শো হয়েছে তার প্রায় সবই হাউসফুল। বেশ কয়েকটি শোর অগ্রিম টিকিটও বিক্রি হয়েছে। মুক্তির আগেই অস্ট্রেলিয়ায় সাড়া ফেলে চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’। ৫ আগস্ট সিডনির হোয়েটস ব্ল্যাকটাউনে ছবিটির প্রিমিয়ার হয়। দর্শকের ঢল নামায় একই দিনে ছবিটির তিনটি শো হয়। সব শো হাউসফুল।  অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি শহরে চলছে ছবিটি। নিউজিল্যান্ডেও মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ‘প্রহেলিকা’র পরিবেশক বাংলাদেশি সংগঠন পথ প্রোডাকশন ও দেশি ইভেন্টস।

বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের সিনেমা শুধু চলছে না; যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও বিপুল আয় করছে। বিদেশে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিবেশনার কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো। রয়েছে বঙ্গজ ফিল্ম, দেশি ইভেন্টস, রিভেরি ফিল্মস, বায়োস্কোপ ফিল্মস, রাদুগাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। বিদেশে বাংলা ছবি প্রদর্শনের যাত্রাটা শুরু হয় ২০১৬ সালে প্রথম কানাডার মেইনস্ট্রিম থিয়েটারে ‘অস্তিত্ব’ সিনেমা মুক্তির মাধ্যমে। পরে একে ‘মুসাফির’, ‘সম্রাট’ ‘শিকারি’, ‘আয়নাবাজি’, ‘নবাব’, ‘দেবী’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘স্বপ্নজাল’, ‘শান’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ প্রদর্শিত হয়। এরমধ্যে ‘শিকারি’, ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘দেবী’, ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ বেশ ব্যবসা করে। ধীরে ধীরে বাজার খুলতে থাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে; যার রেশ ধরে সর্বশেষ আলোচিত ছবি ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ মুক্তি পেয়েছে। ব্যবসাও করছে। বিদেশে সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়াটা খুব একটা কঠিন নয়। এক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে ভালো সিনেমা। নিজ দেশে সেই সিনেমার ভালো প্রচার-প্রচারণা ও দর্শক চাহিদা থাকার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে সিনেমাটি মিনিমাম টু কে  রেজ্যুলশনের ক্যামেরায় শুট করা হতে হবে। সাবটাইটেল থাকতে হবে। শর্তগুলো থাকলেই পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে সিনেমা পাঠিয়ে থাকে। হলগুলোতে সিনেমা পাঠানো, সেন্সর করানো, এর প্রচার-প্রচারণার সব খরচ পরিবেশক প্রতিষ্ঠানই বহন করে। প্রযোজককে শুধু ভার্চুয়াল প্রিন্ট ফি (ভিপিএফ) দিতে হয়। অবশ্য করোনার পর এ প্রক্রিয়াটি এখন আর নেই। বিদেশে প্রদর্শিত সিনেমার কোনো টিকিট যদি ১০০ টাকাও বিক্রি হয়, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেন প্রযোজক। রেনট্র্যাক (কমস্কোর) নামের একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্কে সারা বিশ্বের বক্স অফিস ডাটাবেজ আছে, যেখানে সব মাল্টিপ্লেক্স রিপোর্ট করে। সেখান থেকেই জানা যায় কোন সিনেমা কত টাকা আয় করেছে। গ্রস বক্স অফিস আয় থেকে ১৩-১৫ শতাংশ (কানাডা ও আমেরিকায় ১৩ শতাংশ। তবে কিছু দেশে ১৪ ও ১৫ শতাংশ) ট্যাক্স কেটে রাখার পর যে আয়টা থাকে, সেটাই নিট আয়। তার থেকে কোনো কোনো দেশের মাল্টিপ্লেক্স ৫০ শতাংশ নেয়, কোনো দেশ নেয় ৬৫ শতাংশ। মাল্টিপ্লেক্স তার ভাগ নেওয়ার পর যা থাকে, তার ফিফটি ফিফটি পরিবেশক ও প্রযোজকের মধ্যে ভাগ হয়। এটাই হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি। সিনেমা ভালো চললে ২-৪ শতাংশ বোনাস হিসেবেও অর্থ দিয়ে থাকে কোনো প্রতিষ্ঠান। 

এ সময়টা হলিউড সিনেমার সুপারপিক মৌসুম। তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি সিনেমার দাপট থাকে বিশ্বব্যাপী। তবে এ সময়ও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডার প্রেক্ষাগৃহে আলোচনায় বাংলাদেশের সিনেমা। দেশের বাইরে দেশি ছবির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে নির্মাতা অমিতাভ রেজা বললেন, ‘আয়নাবাজি’ যখন মুক্তি দিই, তখন খুব একটা ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশের বাইরে বাংলাদেশের সিনেমার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। যদিও এখনো বাণিজ্যিক সাফল্য তেমন আসেনি। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বাংলা সিনেমার জন্য নতুন পথ খুলে দিয়েছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘দেশের বাইরে বাংলাভাষী অনেক দর্শক আছেন। দেশের টানে দেশি সিনেমা    দেখতে চান তারা। তবে অবশ্যই এসব দর্শকের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের সংস্কৃতির আবহে সিনেমা বানাতে হবে। বিদেশের মাটিতে দেশি সিনেমার বাজার বাড়াতে হলে গুণগত মানের বিকল্প নেই। কেননা হলিউড, বলিউডের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত তারা।’ বঙ্গজ ফিল্মের প্রতিষ্ঠাতা তানিম মান্নান বলেন, ‘শুরুর দিকে আমাদের সিনেমাগুলো থিয়েটার হল ভাড়া নিয়ে প্রদর্শন করতাম। তখন ভাড়া নিলেও হলের ওয়েবসাইটে আমাদের ছবির পোস্টার বা তথ্য জায়গা পেত না। কারণ, তাদের আস্থার জায়গাটা কম ছিল। গত পাঁচ বছরে সেই  বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। আমরা বড় বড় চেইন থিয়েটার হলে সিনেমা মুক্তি দিতে পারছি। ছবির তথ্যও তাদের ওয়েবসাইটে স্থান পাচ্ছে। এটি কিন্তু বাংলা সিনেমার একটা অর্জন।’ ভবিষ্যতে বাংলা সিনেমা নিয়ে আরও আশাবাদের কথা জানালেন এই কর্মকর্তা। এখন তো আমাদের দেশের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কাজে ভালো করছেন। একসময় এই তরুণেরা সিনেমার ভিএফএক্স, অ্যানিমেশনের কাজ করবেন। তখন শুধু গল্পই নয়, চিত্রায়ণ, কারিগরি দিক থেকেও আমরা এগিয়ে যাব।’

সর্বশেষ খবর