বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সালমান শাহর কথা

এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর

এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর

‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, হায়রে অনেক দিনের পর, এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর, হায়রে এসেছে খবর’। ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিতে সালমানের লিপে গাওয়া এই গানটি যে অল্প সময়ে সত্যি হয়ে যাবে তা কি কেউ ভুলেও কখনো কল্পনা করতে পেরেছিল।  সালমান শাহকে বলা হতো ঢাকাই ছবির সাফল্যের বরপুত্র। তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। সালমানের অভিনয় স্টাইল, পর্দায় তাঁর সপ্রতিভ উপস্থিতি আর নায়কোচিত ইমেজ আজও অন্য তারকাদের কাছে অনুকরণীয়। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান নির্মিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তাঁর অভিষেক। শুরুতেই বিশাল সাফল্য দিয়ে সালমান প্রাণসঞ্চার করেন মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রে। তারপর শুধুই ইতিহাস। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬। শুধুই সাফল্যের পথে হেঁটে যাওয়া। প্রয়াণের মাত্র কদিন আগে কথা প্রসঙ্গে অকাল মৃত্যু নিয়ে সালমান শাহ বলেছিলেন, ‘শুধু আমার নয়, কারও ভাগ্যে যেন বিধাতা এমন মৃত্যু না লিখেন।’ বেঁচে থাকার জন্য যাঁর আকুতি ছিল এমন, তিনি কী করে আত্মাভিমানে নিজেকে সংহার করবেন। এমন প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। সালমান ছিলেন অভিনয়ে, আছেন হৃদয়ে, থাকবেন এই ধরণিতে অনন্তকাল। সালমানের মৃত্যু নেই। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। শ্রদ্ধাভরে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

স্বল্প সময়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ -----------

১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের একটি পর্বে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ নামের একটি গানের মিউজিক ভিডিওতে হানিফ সংকেতের কণ্ঠে গাওয়া গানের প্রধান চরিত্র অপূর্বর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়ায় প্রথম আলোচিত হন। তখন তিনি ইমন নামে পরিচিত ছিলেন। এর কয়েক বছর পর আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ নাটকে ছোট চরিত্রে এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছিলেন। মাত্র চার বছরের অভিনয় জীবনে ২৭টি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র, কিছু দর্শকপ্রিয় নাটক, টেলিফিল্ম এবং বিজ্ঞাপনে মানসম্মত কাজ করে গেছেন সাফল্যের এই বরপুত্র। দুটি চলচ্চিত্রে শ্রুতিমধুর গানও গেয়েছেন।

 

কী ঘটেছিল সেদিন -----------

১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে যান সালমান শাহ। সেখানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন নায়িকা শাবনূর। কিছুক্ষণ পর সালমান তাঁর বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, তাঁর স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। সামিরা এসে দেখতে পান সালমান ও শাবনূর ঘনিষ্ঠভাবে খুনসুটি করছেন। এতে উত্তেজিত হন সামিরা। কিছুক্ষণ পর সামিরা দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। অবস্থা খারাপ দেখে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। সালমানের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন সামিরা। তাঁকে বোঝাতে থাকেন বাদল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সালমান এফডিসির প্রধান ফটকের সামনে নেমে আড্ডা দেন, যা এর আগে কখনো করেননি। রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। সামিরাও তখন ঘরে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সালমান বেডরুমে গিয়ে টিভি দেখেন। তখনো তাঁদের মধ্যে কথা বন্ধ। ১২টার দিকে সালমানের মোবাইলে একটি ফোন আসে। তিনি বাথরুমে গিয়ে কথা বলে বেরিয়ে টিভি বন্ধ করে অডিও ক্যাসেট ছাড়েন। এ সময় আরও একটি ফোন আসে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। উত্তেজিত হয়ে সালমান মোবাইল ফোনসেটটি ভেঙে ফেলেন। ক্ষুব্ধ সামিরা ব্যাগ গুছিয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ফুফুর বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। সালমানের পিএ আবুল ইন্টারকমে দারোয়ানকে গেট না খুলতে নিষেধ করেন। সামিরা ফিরে এলে সালমান তাঁকে ফুফুর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ৬ সেপ্টেম্বর সকালে ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। বাজারে পাঠানো হয় তাঁর দেহরক্ষী দেলোয়ারকে। এ সময় কমরউদ্দিন তাঁর ছেলের ফ্ল্যাটে আসেন। সালমানকে বলেন, মা, ভাই ও তাঁকে নিয়ে সিলেটে যাবেন। এ সময় সিদ্দিক নামের এক প্রযোজকও আসেন। কমরউদ্দিন ও সিদ্দিক চলে যাওয়ার পর সামিরা তাঁর বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বেলা ১১টার দিকে সালমান ঘুম থেকে উঠে দুই কাজের মেয়ের একজনকে ডেকে চা ও পানি খান। কিছুক্ষণ পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা লক করে দেন। ঢোকার আগে আবুলকে বলে যান, তাঁকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। সাড়ে ১১টার দিকে আবুল সামিরাকে জাগিয়ে বলেন, অনেকক্ষণ আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেও তাঁর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সামিরা দরজার ডুপ্লিকেট চাবি খুঁজতে থাকেন। পৌনে ১২টায় ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আবুল ও সামিরা ড্রেসিংরুমের দরজা খুলে দেখেন ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন সালমান। সামিরা ও দুই কাজের মেয়ে সালমানকে উঁচু করে ধরেন। পাশের বাসার কাজের মেয়ে দড়ি কেটে সালমানকে নামিয়ে আনেন। এটি কী হত্যা না আত্মহত্ম্যা, এই প্রশ্নের জবাব নেই।

সালমানের কর্মযজ্ঞ

সালমান শাহ অভিনীত ছবি

কেয়ামত থেকে কেয়ামত, তুমি আমার, অন্তরে অন্তরে, সুজন সখী, বিক্ষোভ, স্নেহ, প্রেমযুদ্ধ, কন্যাদান, দেনমোহর, স্বপ্নের ঠিকানা, আঞ্জুমান, মহামিলন, আশা ভালোবাসা, বিচার হবে, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নেই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার, চাওয়া থেকে পাওয়া, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্র“, বুকের ভেতর আগুন [মোট ছবি ২৭টি]

বিজ্ঞাপনচিত্র

মিল্ক ভিটা, জাগুরার, কেডস, গোল্ড স্টার টি, কোকাকোলা, ফান্টা

ধারাবাহিক নাটক

পাথর সময়, ইতিকথা

একক নাটক

আকাশছোঁয়া, দোয়েল, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন, স্বপ্নের পৃথিবী

 

সে আমার আদরের সন্তান

  --  ববিতা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে সালমান শাহ চারটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে- বাদল খন্দকারের ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, দীলিপ সোমের ‘মহামিলন’, শিবলী সাদিকের ‘মায়ের অধিকার’ ও জাকির হোসেন রাজুর ‘জীবন সংসার’। দুটি ছবিতে সালমানের মায়ের ভূমিকায় এবং দুটি ছবিতে সালমানের ভাবির ভূমিকায় অভিনয় করেন ববিতা। দীলিপ সোমের ‘মহামিলন’ ছবির শুটিংয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ববিতা বলেন, ‘কক্সবাজারে এ ছবির শুটিং হয়েছিল। একটি দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছিল পাহাড়ের ওপর। সেই দৃশ্যটি ধারণের সময় আমি শুটিংয়ে আনা অন্য একটি চেয়ারে বসি। কারণ হোটেল থেকে আমার চেয়ারটি নিতে মনে ছিল না। সালমান বিষয়টি খেয়াল করে এবং শুটিংয়ে তাঁর নেওয়া চেয়ারটি আমাকে দেয়। আমি নিষেধ করার পরও সালমান তাঁর নিজের ব্যবহৃত চেয়ারটি তখনই আমাকে একেবারেই দিয়ে দেয়। সেই চেয়ারটি দীর্ঘদিন আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আরও একটি ঘটনার কথা আমার মনে আছে। যখন মোবাইল ফোন প্রথম বাজারে এলো, সে সময় সাইজে অনেক বড় ছিল। আমি সেই মোবাইল ব্যবহার করতে পারতাম না। সালমানই আমাকে একটি চিরকুটে মোবাইল ব্যবহার করার পদ্ধতি প্রথম শিখিয়ে দিয়েছিল। সেটি দেখে পরবর্তীতে মোবাইল ব্যবহার করা আমার কাছে বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল। সালমানের নিজের হাতের লেখা সেই চিরকুটটি এখনো আমার কাছে বেশ যতেœ রাখা আছে। হারানো এক সন্তানের কথা মনে করে, মাঝে মধ্যে সেই চিরকুট হাতে নিয়ে দেখি। আর মনে মনে বলি, সালমান তুমি যেখানেই আছ সেখানে চিরশান্তিতে কাটুক তোমার সময়। ও একটি কথা আমাকে প্রায়ই বলত, ‘আপন মা না হলেও আপনি আমার সুইট মা’। মা ছাড়া সে আমাকে অন্য কিছুই আর ডাকত না। সত্যিই এতটা বছর পরও তাঁকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। ববিতা বলেন, অভিনয় ছাড়াও সালমানের মধ্যে অনেক গুণ ছিল। বড়দের সম্মান করত। সমবয়সীদের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সন্তানতুল্য এই অভিনেতা আমাকে বলত, ‘আপন-পর বুঝি না, আপনি আমার সুইট মা। তাই মা বলেই আপনাকে ডাকব।’ আমাকে খুশি করার জন্য নয়, সত্যি সত্যিই সালমান যতদিন বেঁচে ছিল, আমাকে মা বলেই ডেকেছে। কখনো মনেই হয়নি যে, সালমান আমার জঠরে জন্ম নেয়নি। এতটাই আপন হয়ে গিয়েছিল যে, সব সময়ই ভাবি সে আমার আরেক আদরের সন্তান।’

সর্বশেষ খবর