শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে সফল অভিনেতা

ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে সফল অভিনেতা

ঢাকার চলচ্চিত্রে মহানায়ক খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ছিলেন ব্যাংকার, অভিনয়ের নেশায় চাকরি ছেড়ে হলেন নামি অভিনেতা, বলা হচ্ছিল প্রয়াত মহানায়ক বুলবুল আহমেদের কথা। তাঁর কর্ম ও অভিনয় জীবনের সাতসতেরো তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে অভিনেতা

বুলবুল আহমেদ। আমাদের চলচ্চিত্রের দেবদাস কিংবা মহানয়ক। বাংলা চলচ্চিত্রের সুদর্শন, সুশিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল এক অভিনেতা। ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা, প্রকৃত নাম তবারুক আহমেদ। আবদুল্লাহ ইউসুফের ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবিতে বুলবুল আহমেদ নাম দিয়ে চলচ্চিত্রে নায়ক হন। ছোটবেলায় গুনগুন করে গান গাওয়ার অভ্যাস ছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ালেখা করার সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন ‘শ্যামলী শিল্পী সংঘ’ নাট্য শিল্পগোষ্ঠী। নাজমুল হুদা বাচ্চু, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, আবদুল জলিল ও আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামকে নিয়ে এই নাট্যগোষ্ঠীর প্রথম নাটক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ প্রদর্শিত হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন এমন মনোবাসনা নিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন। ছবিটি ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় এবং দর্শকদের মাঝে বেশ সাড়া জাগায়। সেই সঙ্গে তবারুক আহমেদ থেকে হয়ে উঠলেন অভিনেতা বুলবুল আহমেদ। পরে আলমগীর কবীরের সঙ্গে বুলবুল আহমেদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁর পরিচালিত সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে, মোহনা, মহানায়ক ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৮২ সালে বুলবুল আহমেদ চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দেবদাস’ ছবিতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সাড়া জাগান।

 

যেভাবে অভিনয়ে আগ্রহ

বুলবুল আহমেদদের বাড়িতেই নাটকের মহড়া হতো। কিশোর বুলবুল প্রায়ই সে মহড়া দেখতেন। পুরান ঢাকার ফুলবাড়িয়ার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউশনে তাঁর বাবার নির্দেশিত নাটকগুলো মঞ্চস্থ হতো এবং বুলবুল আহমেদ সেগুলো দেখতে যেতেন। সেখান থেকেই তাঁর অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মে।

 

বাবার ইচ্ছা

বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে প্রকৌশলী বানানোর। বাবার মৃত্যুর পর ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে নটর ডেম কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং এই কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। নটর ডেম কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করতেন এবং একসময় গ্রুপ থিয়েটার ড্রামা সার্কেল নাট্যগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হন।

 

প্রেম-বিয়ে

তাঁর বিয়েটাও নাটকীয়। ঢাকায় অভয় দাস লেনের পৈতৃক বাড়ির পাশের বাড়ির চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী ফৌজিয়ার সঙ্গে প্রেম গড়ে ওঠে। তখন বুলবুল আহমেদ সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অনেক সামাজিক, পারিবারিক বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে দীর্ঘ ১২ বছরের প্রেমের পরিণতি ১৯৬৩ সালের ২৭ আগস্ট ফৌজিয়া আহমেদ ডেইজিকে বিয়ে করেন। ১৯৬৫ সালে এমএ পাস করার পর ইউনাইটেড ব্যাংকে চাকরিতে যোগদান করার পর ৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রীকে ঘরে তোলেন। বিয়ের পর চট্টগ্রামে তাঁকে বদলি করা হয় এবং সেখানেই তাঁদের সংসার জীবন শুরু। তৎকালীন ইউবিএল ব্যাংক টিএসসি শাখার ম্যানেজার হিসেবে ১০ বছর চাকরি করেন।

 

কেন ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন?

১৯৬৮ সালে ঢাকায় বদলি হয়ে এসে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে  জড়িয়ে পড়েন। মোস্তফা মনোয়ার প্রযোজিত আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত টেলিভিশনে পূর্বাভাস নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন। টেলিভিশনের প্রযোজক আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের ‘ইয়ে করে বিয়ে’ (১৯৭৩) ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলি করেন। ছোটবেলা থেকে যে সুপ্ত বাসনা ছিল চলচ্চিত্রে এবং টেলিভিশনে অভিনয়ের, তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারলেন না বলে নিশ্চিত নির্ভরতার ব্যাংকের চাকরিটি ছেড়ে দেন।

 

মঞ্চ ও টিভি নাটকে

এমসি কলেজে থাকাকালে মঞ্চনাটক ‘চিরকুমার সভা’য় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে উপস্থিত সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরির পাশাপাশি বুলবুল আহমেদ টিভিতে অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘বরফ গলা নদী’। যেটি ১৯৬৪ সালে প্রচারিত হয়। এরপর নিয়মিত টিভি নাটকে কাজ করতে থাকেন। সর্বশেষ টিভি নাটক ২০০৯ সালে ‘বাবার বাড়ি’। অভিনয়ের পাশাপাশি এটি পরিচালনাও করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে টিভি নাটকে নিয়মিত হন। ৪৪ বছরের শিল্পী জীবনে বুলবুল আহমেদ প্রায় ৩০০ নাটকে অভিনয় করেন।

 

চলচ্চিত্র নির্মাণ

অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি সিনেমা পরিচালনাও করেন এই ‘মহানায়ক’। তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে- ‘ওয়াদা’, ‘মহানায়ক’, ‘ভালো মানুষ’, ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’, ‘আকর্ষণ’, ‘গরম হাওয়া’, ‘কত যে আপন’ প্রভৃতি।

 

যত অর্জন

সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), বধূ বিদায় (১৯৭৮), শেষ উত্তর (১৯৮০) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) ছবির পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এই অভিনেতা। রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৮২), ফেরারী বসন্ত (১৯৮৩), রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পান। বুলবুল আহমেদ অত্যন্ত প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় করেছেন দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে। এছাড়া অভিনয় করেছেন প্রায় তিনশর মতো নাটকে। অভিনয় প্রতিভা দেখিয়ে চারবার জিতেছেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ‘দুই নয়নের আলো’।

 

সাদামাটা জীবন

আশির দশকের মাঝামাঝি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ। বুলবুল আহমেদ থাকতেন ঢাকার হাটখোলা রোডের এক বাসায়। সেখানে আর ১০টি পরিবারের মতোই সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর চলাফেরা ছিল। বুলবুল আহমেদের জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে ঢাকায় হলেও পৈতৃক বাড়ি ছিল ভারতের মেদিনীপুরে। ২০১০ সালের ১৫ জুন বুলবুল আহমেদ চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান।

সর্বশেষ খবর