শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্যান্ডউইচ বিক্রেতা থেকে বলিউড মুঘল

স্যান্ডউইচ বিক্রেতা থেকে বলিউড মুঘল

ইউসুফ খান, তাঁর বাবা ছিলেন ফল ব্যবসায়ী। বাবার ফলের ব্যবসা দেখার পাশাপাশি নিজে স্যান্ডডউইচের দোকান দেন। তবে বেশি দিন তাঁকে এসব ব্যবসা করতে হয়নি। ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন বলিউড বাসিন্দা। বলিউডের প্রথম এই সুপারস্টারকে বলিউড মুঘল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

স্যান্ডউইচের দোকান দিয়ে পেশা শুরু

বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’ ও ‘বলিউড মুঘল’ বলা হতো তাঁকে। হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন বলিউড হিরো। সুদূর পেশোয়ার থেকে বলিউডের সফর মোটেও সহজ ছিল না দিলীপ কুমারের। বলিউড দাপিয়েছেন ছয় দশক ধরে। দিলীপ কুমারের বাবা ছিলেন ফলের ব্যবসায়ী, তাঁর ফলের বাগানও ছিল। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে, ১২ সদস্যের পরিবার নিয়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান দিলীপ কুমারের বাবা। দিলীপ কুমার নাসিকের কাছাকাছি দেওলিয়ার বার্নস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তবে বাবার সঙ্গে একরোখা ছেলের সম্পর্ক কিছুতেই ভালো হতো না। কথা কাটাকাটির জেরে ১৯৪০ সালের এক দিন বাড়ি ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন কিশোর ইউসুফ। তাঁর ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন রাজ কাপুর। বাড়ি ছাড়ার পর ইউসুফের পুণের কথা মনে পড়ল। সেখানে পৌঁছে আলাপ হলো এক ক্যাফে মালিকের সঙ্গে। পাশে পেলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতিকে। তাঁদের সহায়তায়ই দিলীপ কুমার সেনাবাহিনী ক্লাবের কাছে স্যান্ডউইচের দোকান খুলে ফেলেন। তাঁর ব্যবসাও রমরমিয়ে চলতে শুরু করে। ইংরেজি ভালো বলতে আর লিখতে পারতেন। ব্যবসা দাঁড় করাতে সময় নিলেন না। বাড়ি ফিরলেন ৫ হাজার টাকা জমিয়ে। বেশ কয়েক বছর সেখানে কাজ করার পর ফের মুম্বাই ফিরে বাবার ফলের ব্যবসায় হাত লাগান। তখনো অবধি জীবনের লক্ষ্য ছিল, ব্যবসায়ী হওয়া।

 

যেভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে

মুম্বাই ফেরার পর তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মাসানি নামের এক ব্যক্তির। তিনি ইউসুফকে দেখেই বুঝতে পারেন যে, তিনি ব্যবসার জন্য তৈরি হননি বরং তাঁর স্থান গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে। মাসানির হাত ধরেই বম্বে টকিজে প্রবেশ দিলীপ কুমারের। এরপর অভিনেত্রী দেবিকা রানি তাঁকে প্রথম অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় মোহাম্মদ ইউসুফ খানের প্রথম ছবি ‘জোয়ার ভাটা’।

 

যেভাবে ইউসুফ থেকে দিলীপ

তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ইউসুফ খান হলেও হিন্দি লেখক ভগবতি চরণ বর্মা তাঁকে বড় পর্দায় নাম দেন দিলীপ কুমার। অন্য এক সূত্রে জানা যায় প্রথম ছবি ‘জোয়ার ভাটা’য় অভিনয় করার সময় ইউসুফ থেকে তাঁকে দিলীপ কুমার নাম রাখতে সাহায্য করেছিলেন তাঁর প্রথম ছবির প্রযোজক দেবিকা রানি। সে সময় বলিউডে নাম বদল ছিল বেশ সাধারণ ঘটনা। জনপ্রিয়তা পেতে ছোট নাম বা আকর্ষণীয় নামের পেছনে ছুটতেন অনেকেই। তবে দিলীপ কুমার নাম বদল করেছিলেন অন্য কারণে। বলা যায় বাবার কাছে মার খাওয়ার ভয়ে। আত্মজীবনীতে এই অভিনেতা লিখেন, প্রথমে দেবিকা রানিই তাঁকে নাম বদলানোর পরামর্শ দেন। তবে তিনি রাজি হয়েছিলেন অন্য কারণে। দিলীপ কুমার লেখেন, তাঁর বাবা অভিনয় পেশার একেবারে বিরোধী ছিলেন। এসব ‘নাটক’ মনে হতো তাঁর। উপরন্তু বন্ধুপুত্র রাজ কাপুর অভিনয়ে পা রাখায় আরও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য বাবা মেনে নিয়েছিলেন ছেলের এই কাজ। অভিনয়ের প্রশংসাও করেছিলেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দিলীপ কুমারকে। বক্স অফিসে ‘জোয়ার ভাটা’ সেভাবে সফলতা না পেলেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। পাকিস্তানের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নুরজাহানের বিপরীতে ১৯৪৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জুগনু’ দারুণ হিট হয়। এরপর দিলীপ কুমার ১৯৪৮ সালে পরপর ‘শহীদ’ ও ‘মেলা’ দুটি হিট ছবি উপহার দেন দর্শকদের। ১৯৪৯ সালে দিলীপ কুমার মেহবুব খানের ‘আন্দাজ’ ছবিতে অসাধরণ চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর সঙ্গে সহ-অভিনেতা ছিলেন রাজ কাপুর ও নার্গিস। এই ছবিও দারুণ সফলতা পায়। ওই একই বছরে বক্স অফিস আরও একটি হিট ছবি পায়, যেখানে দিলীপ কুমার অভিনয় করেছিলেন। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি। ৬৫-টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।

 

যেভাবে মুভি মুঘল

দিলীপ কুমারের আগে কিংবা সমসাময়িক সময়ে বলিউড তারকা হিসেবে এমন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর কেউ লাভ করেনি। তাঁর ছবি মুক্তি পাওয়া মানে দর্শকের ঘুম হারাম। ওই সময় মানুষ দিলীপ কুমারের হেয়ার স্টাইল, কথা বলার ধরন, পোশাক পরা, হাঁটাচলা, কথা বলা সবই অনুকরণ করত। এই কারণে সহজেই তিনি বলিউড মুঘল হয়ে ওঠেন। তবে কে আসিফ পরিচালিত বিখ্যাত ছবি ‘মুঘলে আজম’-এ মুঘল সম্রাট আকবরের পুত্র শাহজাদা সেলিমের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের কারণে তিনি সত্যিকার অর্থে ‘বলিউড মুভি মুঘল’ হয়ে ওঠেন।

 

গিনেস বুকে স্থান

দিলীপ কুমারকে ব্যাপকভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একজন ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুরস্কার বিজয়ী হওয়ার জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের জায়গা দখল করে নেন। তিনি তাঁর অভিনয় জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে আটবার ফিল্মফেয়ারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কারসহ ১৯ বার ফিল্মফেয়ারে মনোনয়ন পেয়েছেন। দিলীপ কুমারকে ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়।

সর্বশেষ খবর