বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দর্শক কেন সিনেমা হলে যাবে

দর্শক কেন সিনেমা হলে যাবে

কয়েক বছর ধরে সিনেমা হলে আবার ফিরতে শুরু করেছে দর্শক। কারণ তারা মনের মতো গল্পের ছবি পাচ্ছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকেই মূলত সিনেমা হল বিমুখ হয়ে পড়েছিল দর্শক। প্রথমে অশ্লীলতা, নকল আর পাইরেসির দাপট। একসময় এসব সমস্যার সমাধান হলেও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক আর সিনেমা হলে ফেরেনি। এ কারণে দেশের ১ হাজার ৪০০ সিনেমা হল এখন মাত্র ৬০-এর ঘরে এসে ঠেকেছে।  এ অবস্থার উত্তরণ নিয়ে কথা বলেছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। তাঁদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নিজস্ব গল্পে ছবি বানাতে হবে

অনুপম হায়াৎ

চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক

প্রযুক্তিগত, নির্মাণগত, প্রতিভাগত ও ঐক্যের সংকট শিল্পটির অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন স্বল্প খরচে নেটে দেশি-বিদেশি ছবি দেখা যায়। সবার হাতে হাতে রয়েছে মোবাইল। তাই সহজেই সিনেমা দেখার ব্যবস্থা এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এতে প্রকারান্তরে সিনেমা হলে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। তা ছাড়া মানসম্মত ছবি নির্মাণ ও সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ দুঃখজনক হারে কমেছে। নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পে ছবি বানাতে হবে। তাতে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। চলচ্চিত্র একটি যৌগিক শিল্প। এর পরিবেশও যৌগিক হতে হবে। অব্যবস্থাপনা ও অনৈক্য এই শিল্পের অধঃপতন ডেকে আনছে। একসময় এ শিল্পে মধ্যস্বত্বভোগী বলে কোনো পক্ষ ছিল না। হঠাৎ এ পক্ষের উদ্ভবের কারণে প্রযোজককে প্রতি মুহূর্তে তাদের হাতে নাকাল হতে হচ্ছে। এমনিতেই চলচ্চিত্রের ব্যবসা মন্দ। এর ওপর যদি এ পক্ষ অযৌক্তিকভাবে প্রযোজকের কাছ থেকে বিশাল টাকার অঙ্ক হাতিয়ে নেয় তাহলে প্রযোজককে তো পথে বসতেই হবে। নিয়ম হচ্ছে পণ্য উৎপাদনকারী সরাসরি তার পণ্য বাজারজাত করবে। এখানে তৃতীয় পক্ষের কি দরকার। এরা কাদের সৃষ্টি। চলচ্চিত্রের সব পক্ষ মিলে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

 

দর্শক উপযোগী ছবি হচ্ছে না

অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা শহরেই যথেষ্টসংখ্যক সিনেমা হল নেই। দর্শক কোথায় যাবে? সিনেমা হলের ব্যবসা এখন অলাভজনক হয়ে পড়েছে। দেখার উপযোগী ছবি হচ্ছে না। আগে বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মাণ হতো। সুস্থধারার

ছবিও তেমন তৈরি হচ্ছে না। ফলে দর্শকদের ওপর সিনেমা হলে না যাওয়ার দায় চাপানো যাবে না। যানজট ঠেলে সময় আর অর্থ নষ্ট করে কেন সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবে। আগে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হল ছিল একমাত্র স্থান। এখন মোবাইল ফোন, নেট, স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ নানা মাধ্যমে নানা ছবি দেখা যায়। এতে বড় পর্দায় ছবি দেখার মজা না পেলেও মিনি ফরম্যাটে দেখে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। মানে প্রযুক্তিগত কারণে যন্ত্রপাতি, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন এসব মাধ্যমের কারণে ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর কাটাতে সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে চার-পাঁচটি স্ক্রিন থাকছে তাতে চার-পাঁচটি ভিন্ন মুভি চলছে। এতে দর্শক তার রুচিমতো ছবি বেছে নিতে পারছে। এখানেও মাল্টিপ্লেক্স বাড়ানো দরকার। সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সরকার যদি ঋণ দেয় বা প্রাইভেট খাতেও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বিনোদনের জন্য এটি হবে একটি রেভলিউশন।

 

সেন্সর নয়, নির্বাচনি বোর্ড দরকার

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা হলের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে ভালো ছবি, গল্প আর নির্মাতার অভাব তো রয়েছেই। এখন ছবি দেখার নানা মাধ্যম রয়েছে। তাতে বিশ্বের সব ছবি দেখতে পারছে মানুষ। তাই অপশন যখন বেশি তখন প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার। শিল্পীদের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পুরনোদের নিয়ে এখনো আমরা আটকে আছি। নতুনদের স্বাগত জানানো দরকার। চলচ্চিত্র অঙ্গনে দলাদলি, রাজনীতি মোটেও কাম্য নয়। এতে সৃজনশীল এ শিল্পের ক্ষতি হয়। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি টিমওয়ার্ক। যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণাও অনাকাক্সিক্ষত। সিনেমা হলে শুধু এফডিসিভিত্তিক ছবি চালালে হবে না। সব দেশের মানসম্মত ছবি প্রদর্শন করা উচিত। উপমহাদেশীয় ছবিকে ৫০ বছর ধরে প্রটেকশন দিয়ে কি আমাদের শিল্পের কোনো উন্নতি হয়েছে? সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে নির্বাচনি বোর্ড গঠন করে দেশবিদেশের ছবি বাছাই করে প্রদর্শন করতে হবে। বিদেশি ছবি বাংলায় সাবটাইটেল করে প্রদর্শন করলে যারা ইংরেজি বোঝে না তাদের সুবিধা হবে এবং কর্মসংস্থানও হবে। দর্শক ফেরাতে গল্প, চিত্রনাট্য, শিল্পী, নির্মাতা এবং ক্যামেরায় চোখ রাখার অভাব দূর করতে হবে।

 

মানের প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে

হাবিবা রহমান

সহকারী অধ্যাপক, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এখন কিন্তু আলাদা করে নিউজপেপার, টিভি, সিনেমা, নেট দেখে মানুষ। সবার হাতে হাতে মোবাইল চলে এসেছে। তাই সিনেমা হলে না গিয়ে প্রায় সবাই এখন মোবাইলে ছবি দেখে। অন্যদিকে বেশির ভাগ সিনেমা হলের পরিবেশও দর্শক উপযোগী নয়। দর্শক তাই মোবাইলেই বিশ্বের সব ছবি দেখছে। দেখার মাধ্যমের পরিবর্তনের কারণে সিনেমা হল দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ছবি, গল্প ও নির্মাণ মানসম্মত নয়। নেটে ছবি দেখে বাইরের ছবির সঙ্গে এ দেশের ছবির তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে দর্শক। তাই তাদের যেমন তেমন নির্মাণ আর গল্পের ছবি দিয়ে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। সিনেমা হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল মাধ্যম। সিনেমা বড় পর্দায় দেখার বিষয় বলে বড় পর্দায় দেখার সুষ্ঠু অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সিনেমা হল ভেঙে কেন শপিং মল নির্মাণ হবে। চলচ্চিত্র শিল্পকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের উদ্যোগ নিতে হবে। সিনেমা হলের পাশাপাশি সিনেপ্লেক্সও বাড়াতে হবে এবং ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর