সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
আলাপন

হুমায়ূন আহমেদ অনেক মজার মানুষ ছিলেন...

হুমায়ূন আহমেদ অনেক মজার মানুষ ছিলেন...

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের আজ ৭৫তম জন্মদিন। এই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব ‘ম্যাজিক মুনশি’ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে তাঁর প্রিয় একজন মানুষকে নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখেছিলেন। সেই প্রিয় মানুষটি হলেন জাদুশিল্পী ‘জুয়েল আইচ’। যাঁর সঙ্গে ছিল দারুণ সখ্য।  আজকের এই বিশেষ দিনে বন্ধু হুমায়ূনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন জুয়েল আইচ। লিখেছেন -  পান্থ আফজাল

 

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আপনার দারুণ সখ্য ছিল। তিনি আজ শুধুই স্মৃতি...

তিনি ছিলেন অত্যন্ত কাছের, বন্ধুর মতো। সুযোগ পেলেই হুমায়ূন আহমেদের বাসায় চলে যেতাম। দুজনে আড্ডা দিতে দিতে সময় পার হয়ে যেত। যখন যা মনে চাইত তাই করতেন। তিনি আমাকে নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন। তাঁর একটি নাটকে অভিনয়ও করেছিলাম। নিয়মিত আড্ডা দিতাম হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির গুলতেকিন বাসা আর আমাদের বাসায়। সময় পেলেই চলে আসতেন।

 

তিনি চলে যাওয়ার শেষের সময়ের আড্ডার কিছু ঘটনা শেয়ার করবেন?

তিনি আমার জীবনের জন্য প্রচন্ড একটা কষ্টের নাম। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একেবারে কলিজার লোক। বিচিত্র রকমের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, কাছে ডাকতেন, মজা করতেন। প্রতিদিন আড্ডার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁর লেখা স্ক্রিপ্টও থাকত সেখানে। তিনি কীভাবে মজা করবেন, তাঁর পরিকল্পনাও করে রাখতেন। হুমায়ূন ভাই শেষের সময় যখন চলে গেলেন আমেরিকায়, মাঝখানে ফিরেও এসেছিলেন। সেই সময়ের আগের পরপর তিন রাত আমরা রাত ৩টা পর্যন্ত আড্ডাও দিয়েছি।

 

হুমায়ূন আহমেদ কেমন মানুষ ছিলেন?

তিনি অনেক মজার মানুষ ছিলেন। তিনি গুণীকে সমাদর করতেন। একবার কুদ্দুছ বয়াতির দলকে বাসায় ডাকলেন গান শুনবেন বলে। তো তাদের রাতে শুতে দেওয়ার সময় ঘটল বিপত্তি। তারা তো এমন বিছানায় কখনো ঘুমায়নি। তাই ঘুমাচ্ছিল না, বসে ছিল। হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডেকে বললেন, এক কাজ কর, অ্যাস্ট্রের যে ছাই আছে সেগুলো হাতে-পায়ে মাখ। এরপর নিচে বিছানা পেতে শুয়ে পড়। ওমা! সত্যিই তারা তাই করল। সেদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে খুশি খুুশি মনে বয়াতি বললেন, স্যার কী যে বুদ্ধি দিলেন, রাতে অনেক ভালো ঘুম হয়েছে।

 

আপনার বাসার দেয়ালে ঝুলানো তাঁর আঁকা একটি পেইন্টিং দেখেছিলাম...

হুমম... ওটি হুমায়ূন আহমেদ দিয়েছিলেন। তিনি ভালো পেইন্টিংও করতেন। শেষবার যেদিন তিনি অসুস্থতার কারণে আমেরিকায় চলে যান, সেদিন এই কাঁচা ছবিটা উপহার হিসেবে দিয়ে যান। রং তখনো শুকায়নি।

 

তাঁর লেখা একটি উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে ছিলেন আপনি। কোনো বইটি?

সেটি ‘ম্যাজিক মুনশি’ উপন্যাস। এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক-নির্মাতা এই উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে আমাকে নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখেছিলেন। ‘জুয়েল আইচ, জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্ট জয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। তিনি নামতে ভুলে গেছেন’।

 

তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে ম্যাজিশিয়ান চরিত্রে অভিজ্ঞতা...

এখনো আমার মনে পড়ে, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ সারা দেশের টিভি দর্শকদের বিমোহিত করে ফেলেছিল। যেদিন ‘এইসব দিনরাত্রি’ প্রচারিত হওয়ার কথা থাকত, সেদিন অনেক আগে থেকে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসত। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। যেন নাটক নয়, কিছু পরে কারফিউ শুরু হবে। এ যেন ছিল অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার! এমনকি আমিও তখন এই নাটক দেখার জন্যে আমার জাদু দলের সবাইকে নিয়ে অডিটোরিয়ামের গ্রিনরুমে টিভি সেট করে নিতাম। এই নাটক দেখতে দেখতে আমার লাইভ ম্যাজিক শোয়ের প্রস্তুতি নিতাম। তখন আমার প্রায় সব ম্যাজিক শোর সময়ও নির্ধারণ করতাম এই নাটক প্রচারের সময় মাথায় রেখে। কারণ, হুমায়ূন আহমেদের নাটক না দেখে কেউ আমার ম্যাজিক দেখবেন, এমন সাহস নিয়ে স্টেজে ওঠা সম্ভব তখন ছিল না আমার। এবার বলি, হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটক নিয়ে আরেকটি ঘটনার কথা। বিটিভিতে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে একজন তরুণ ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র ছিল। এক বড়লোকের বাড়ির চিলেকোঠায় থেকে লেখাপড়া করে। তার প্রেমে পড়ে গেল বাড়ির আদুরে মেয়েটি। এরকম যখন গল্প এগোচ্ছে, তখন এক দিন মুস্তাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে আমার কাছে ফোন এলো। তিনি আমাকে বললেন, জুয়েল, টিভি স্টেশনে একটু আসতে পারবেন? আমি বললাম, অবশ্যই। ফোনে কথা বলা শেষ করে আমি দ্রুত রওনা দিলাম বিটিভির উদ্দেশে। মুস্তাফিজ ভাইয়ের রুমে গিয়ে ‘এইসব দিনরাত্রি’র প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ কলাকুশলীদের দেখতে পেলাম। শুরুতেই মুস্তাফিজ ভাই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে সঙ্গে আমি হুমায়ূন আহমেদকে বলে ফেললাম, ‘আমি আপনার বিরাট ফ্যান’। এই বলে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম তাঁর দিকে। আমার সঙ্গে করমর্দন করতে করতে হুমায়ূন ভাই বললেন, কে কার ফ্যান? আমি তো আপনার জাদুর ফ্যান! তারপর বিটিভি ভবনে বসে আলাপচারিতার মাঝে মুস্তাফিজ ভাই আমাকে বললেন আসল কথাটা। তিনি আমাকে সরাসরি জানালেন, ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে জুয়েল আইচ নামে একজন ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র আছে। এই নাটকে আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে। আমিও ভাবনাচিন্তা না করে বলে দিলাম, ‘অবশ্যই করে দেব। আনন্দের সঙ্গে করে দেব’। আলাপের পর উপস্থিত সবাই আমাকে অনুরোধ করলেন, জুয়েল আইচকে কাছে পেয়ে জাদু না দেখে বিদায় দেওয়া যাবে না। দেখি, হুমায়ূন ভাইও সায় দিলেন সবার সঙ্গে। কিন্তু আমি তো জাদু দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি। কাজেই আমি সেখানে উপস্থিত একজনের কাছে থেকে একটি পয়সা চেয়ে নিলাম। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, সেটি কয় পয়সা ছিল। এবার জাদুর মাধ্যমে পয়সাটার ধারালো একটা পাশ অতি ধীরে ধীরে বাম বাহুর মধ্যে ঢুকে গেল। প্রায় সবাই হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন লক্ষ্য করলাম, হুমায়ূন ভাই দেখি একটু শক্ত হয়ে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার হাতের দিকে। এরপর আমার ডান বাহু থেকে ধীরে ধীরে কয়েনটি বেরিয়ে আসার পালা। এখন খেয়াল করলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দৃষ্টি আরও তীক্ষè। তাঁর চোখে বিস্ময়ের পাশাপাশি আমার জাদুটি আবিষ্কারের বাসনা লক্ষ্য করলাম। সেদিন থেকেই আমাদের যে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হলো তা ক্রমেই সম্পর্কের শিকড় থেকে শিখরে প্রোথিত হলো। এরপর থেকে আমাদের সম্পর্ক হলো বন্ধুত্বের। একসময় সম্পর্ক আরও গাঢ় হলো।

সর্বশেষ খবর