শিরোনাম
শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

উত্তম কুমার গলায় পরলেন শ্মশানের মালা

আলাউদ্দীন মাজিদ

উত্তম কুমার গলায় পরলেন শ্মশানের মালা

১৯৫৬ সাল। মহানায়ক উত্তম কুমার প্রযোজনা করলেন বিখ্যাত ‘হারানো সুর’ ছবিটি। পরিচালক আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা অজয় কর। ছবির সংগীত পরিচালনা করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’। কিন্নরকণ্ঠী গীতাদত্তের গলায় গানটির চিত্রায়ণকালের দুটি মজার ঘটনা ছিল এমন-

 

ওগো তুমি যে আমার গানের নেপথ্যে

এ ছবির সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঠিক করেছিলেন নায়কের স্মৃতিলোপ ও বিরহ উপলক্ষে একটি বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করবেন সিনেমাটিতে। আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে, গেছে বেঁকে গেছে বেঁকে আমার ফুলে আর কি কবে, তোমার মালা গাঁথা হবে তোমার বাঁশি দূরের হাওয়ায়, কেঁদে বাজে কারে ডেকে। সিনেমার গানে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহারের জন্য বিশেষ নিয়ম-কানুনের ব্যাপার আছে। সেই অনুমতি পেতে সম্ভবত বিপত্তি হচ্ছিল, কিন্তু সিনেমার ওই সিকোয়েন্সে ওরকম একটি গানও যে ভীষণ দরকার! গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন ও সুরকার হেমন্তের মিলিত ফসলে দাঁড়ালো সেই অবিস্মরণীয় গান, আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে, তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি, আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে, সেই শপথের মালা খুলে, আমারে গেছ যে ভুলে। তোমারেই তবু দেখি বারে বারে আজ শুধু দূরে থেকে, আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে।

 

পরিচালক অজয় কর দুঃখ করে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, আজও উত্তম কুমারকে জানাতে পারিনি যে, সেদিনের ওই গানের দৃশ্যের মালাটি ক্যাওড়াতলা শ্মশান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আসলে শুটিং যাতে ভেস্তে না যায়, তাই বোধহয় সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন পরিচালক...

 

উত্তম কুমারকে শ্মশান থেকে আনা মালা পরানো হয়েছিল

‘হারানো সুর’-এর এ গানটির শুটিং চলছে। অভিনয়ে হিট জুটি উত্তম-সুচিত্রা। লোকেশন টালিগঞ্জ স্টুডিও। গুরুত্বপূর্ণ এক দৃশ্যের শুটিং হবে। তার আগেই ঘটে গেল এক কাণ্ড! ১৯৫৬ সালের কথা। সেই সময়ে টালিগঞ্জের চেহারা কীরকম ছিল তা আজ চিন্তারও অতীত। বিরাট বিরাট গাছ-গাছালি। সন্ধ্যা হলে পথঘাটে সেরকম লোকজনও দেখা যেত না। আর রাত হলে তো কোনো কথাই নেই! নিস্তব্ধতা, অন্ধকার ঘিরে ধরত স্টুডিও চত্বরকে। তারকাদের অনেকের কাছেই সেই পরিবেশ খানিক ভয়ংকর ঠেকত। তো এক সন্ধ্যায় টালিগঞ্জ স্টুডিওতে হারানো সুরের এ গানের দৃশ্যের শুট চলছে। পরিচালক অজয় কর একেবারে শশব্যস্ত। ক্যামেরা, প্রপস... ইত্যাদি প্রয়োজিনীয় জিনিস সব প্রস্তুত কিনা কড়াভাবে খুঁটিয়ে দেখছেন। সেখানেই এক গোল বাঁধল, গানের দৃশ্যে প্রয়োজন দুটো মালার। আর সেখানে রয়েছে একটি মালা। এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়েছে অনেকক্ষণ হলো। গাড়ি-ঘোড়ার সমস্যা। আশপাশে কোনো বাজার তো দূরের কথা, একটা ফুলের দোকানও সেই সময়ে খোলা পাওয়া যাবে না। বাসও একটাই চলে তখন ওই রুটে। ৬ নম্বর। ব্যস। টালিগঞ্জ থেকে তখন কাছাকাছি বাজার বলতে শুধু লেক মার্কেট। এদিকে উত্তম-সুচিত্রা তৈরি ‘শুধু একবার বলো’ গানের দৃশ্যে শুটের জন্য। পরিচালক অজয় করের তো তখন মাথায় হাত! কারণ মালা প্রয়োজন দুটো, সেখানে রয়েছে একটা। আর সেটা যদি শুধু উত্তম কুমারকে দেওয়া হয় তাহলে আর রক্ষে নেই মিসেস সেনের হাত থেকে! প্রচণ্ড রাগারাগি করবেন। আবার যদি শুধু সুচিত্রার গলায় মালা দেওয়া হয় তাহলেও উত্তম কুমার মনোক্ষুণ্ন হতে পারে। অতঃপর অজয় কর একজনকে পাঠালেন মালা জোগাড় করতে। মালা এলো। গানের দৃশ্যের শুটিংও দিব্যি সুন্দরভাবে উতরে গেল। তখনো কিন্তু উত্তম কুমারের অজানা যে সেই মালাটি কোথা থেকে আনা। পরবর্তীকালে পরিচালক অজয় কর দুঃখ করে ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন, “আজও উত্তম কুমারকে জানাতে পারিনি যে, সেদিনের ওই গানের দৃশ্যের মালাটি ক্যাওড়াতলা শ্মশান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।” আসলে শুটিং যাতে ভেস্তে না যায় তাই বোধহয় সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন পরিচালক অজয় কর। ভাবা যায়, বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’কে কিনা শ্মশান থেকে আনা মালা পরে শুটিং করতে হয়েছিল। অবশ্য উত্তম কুমার জানলেও না করতেন না, কারণ চলচ্চিত্রের প্রতি তিনি ছিলেন অসামান্য নিবেদিতপ্রাণ।

সর্বশেষ খবর