কলকাতার চলচ্চিত্রে এরই মধ্যে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের তারকা জয়া আহসান, শাকিব খান ও ফেরদৌস। এর আগে একক আধিপত্য ছিল নায়করাজ রাজ্জাকের। আশির দশকে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর বিশাল শূন্যতার মধ্যে পড়েছিল টালিগঞ্জের সিনেমা। একের পর এক ছবি মুনাফা হারানোর ফলে কমে এসেছিল প্রযোজক, পরিচালকের সংখ্যাও। অনেক নামি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। শিল্পীরাও বেকার হয়ে পড়ে। সেই মন্দা অবস্থা কাটিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে আবারও ঘুরে দাঁড় করিয়েছিলেন কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের নির্মাতা স্বপন সাহা। তিন ক্যাপ্টেনের কাঁধে ভর করে তখন এগিয়েছিল কলকাতার সিনেমার জাহাজ। তারা হলেন- স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরী ও প্রভাত রায়। এ ত্রয়ীর মধ্যে ব্যতিক্রম নির্মাণ দিয়ে এগিয়ে ছিলেন ঢাকার স্বপন সাহা। তিনিই গড়ে তুলেছিলেন প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণার জুটি। একের পর এক সুপারহিট ছবি দিয়ে তিনি কলকাতার সিনেমা শিল্পকে চাঙ্গা করে তুলেছিলেন। আশি দশকের মাঝামাঝি সময় তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে সিনেমা নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। টানা সিনেমা বানিয়েছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের সুপারহিট অনেক ছবি তিনি কলকাতায় রিমেক করেছেন। তার মধ্যে ‘সুজন সখী’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘ভাই আমার ভাই’, অবুঝ মন’, ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’ উল্লেখ্য। কলকাতায় তিনটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস, এস কে মুভিজ, টি সরকার প্রোডাকশন-এর জয়জয়কার হয় স্বপন সাহাকে দিয়ে। ঢাকার এ নির্মাতার ছবি দিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা ঘরে তুলেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এস কে মুভিজের কর্ণধার অশোক ধনুকা বিনা সংকোচেই বলেছেন, ‘উত্তম কুমার মারা যাওয়ার পর ইন্ডাস্ট্রি ধসে গিয়েছিল। তখন হাল ধরেছিলেন অঞ্জন চৌধুরী ও স্বপন সাহা। সে সময় স্বপন সাহা ৯ দিনে ছবি বানিয়েছেন। ছবির খরচ ৯ লাখ টাকা। কিন্তু ছবি হিট। অভিনেতা প্রসেনজিতও বলেছেন, ‘স্বপন সাহা ইন্ডাস্ট্রিকে যা দিয়েছেন তার কোনো তুলনা হবে না। আমি একের পর এক হিট ছবি করেছি তার সঙ্গে। আজ যে ভেঙ্কটেশকে নিয়ে এত কথা হয়, ওরা স্বপনদার সঙ্গে ‘ভাই আমার ভাই’ বলে একটা ছবি করেছিলেন। সেটা প্রায় ৫০ সপ্তাহ চলেছিল। ঢাকার ‘বাবা কেন চাকর’-এর মতো ছবি যদি কলকতায় রিমেক না হতো তাহলে কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আজ এ অবস্থায় পৌঁছত না।’ কলকাতায় সফল শাবানা, ববিতা, আলমগীর, চম্পাও। কলকাতায় ‘বাবা কেন চাকর’ ছবি দিয়ে ওপার বাংলার ইন্ডাস্ট্রিতে তুমুল জনপ্রিয়তা পান রাজ্জাক। এরপর তিনি কাজ করেন ‘অন্নদাতা’, ‘জন্মদাতা’ ছবিতে। ববিতা ছিলেন ঢাকাই সিনেমার প্রথম অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আর সেই সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া কলকাতার ‘অশনি সংকেত’ ছবির মাধ্যমে। এ ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন প্রখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবিটিতে অভিনয় করে তিনি কলকাতার দর্শকদের মনে দাগ কেটেছেন। একই বছরে যৌথ প্রযোজনায় আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবি দিয়েও সাড়া পান ববিতা। চিত্রনায়ক আলমগীরও কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিতে নব্বই দশকে নির্মাণ করেন ‘মায়ের আশীর্বাদ’ এবং সফল হন। কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিতে সাফল্য পান ঢাকার শাবানাও। আশির দশকে তিনি অভিনয় করেন শক্তি সামন্তের ‘বিরোধ’ ছবিতে। রোজিনা কলকাতার দর্শক মাতিয়েছিলেন ‘অবিচার’ ছবি দিয়ে। ওই সময় কলকাতায় আলোচিত ছিলেন চম্পা ও রাইসুল ইসলাম আসাদও। তারা জুটিবেঁধে কলকাতায় বাজিমাত করেছিলেন গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবি দিয়ে। এরপর আসাদকে দেখা গিয়েছিল ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবিতেও। আর চম্পা অভিনয় করেছিলেন গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’ এবং ‘মনের মানুষ’ ছবিতে। এ ছাড়াও কলকাতার চলচ্চিত্রে সফল আরও একটি নাম অঞ্জু ঘোষ। ১৯৯৬ সালের পর থেকেই তিনি কলকাতায় নিয়মিত কাজ করছেন। ঢাকার ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অঞ্জু। কলকাতায়ও এ ছবিটি রিমেক করা হয়। এরপর তাকে দেখা গেছে ‘আদরের বোন’ সহ কলকাতার প্রায় অর্ধ শতাধিক চলচ্চিত্রে। কলকাতায় বাংলাদেশি শিল্পী হিসেবে রাজকীয় অভিষেক ঘটেছিল চিত্রনায়ক ফেরদৌসের। এ ছাড়া কলকাতার একক প্রযোজনায় বেশকিছু সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করেন ফেরদৌস। সর্বশেষ কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিতে বাজিমাত করা দুই তারকার নাম শাকিব খান ও জয়া আহসান। ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মুক্তি পায় শাকিবের ‘আমার ভাই আমার বোন’। কলকাতায় শাকিবের বাজিমাত করা শুরু হয় ২০১৬ সালে ‘শিকারি’ ছবি দিয়ে। এরপর মুক্তি পাওয়া ‘নবাব’ ছবিটিতেও শাকিবকে লুফে নেয় কলকাতার দর্শক। বর্তমানে তিনি সেখানেও সুপার স্টারের খ্যাতি পাচ্ছেন। কলকাতার রানি এখন বাংলাদেশের জয়া আহসান। একের পর এক হিট এবং আলোচিত সিনেমা উপহার দিয়ে টালিগঞ্জের নির্মাতাদের প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন তিনি। সেখানকার অভিনেত্রীদের প্রথম এবং শেষ প্রতিদ্বন্দ্বিও তিনি। বিশেষ করে কৌশিক মুখার্জির ‘বিসর্জন’ ছবিটি দিয়ে সমগ্র ভারত মাতিয়েছেন। অরিন্দম শীলের ‘আবর্ত’ দিয়ে ২০১৮ সালে কলকাতা যাত্রা শুরু করেছিলেন জয়া। এরপর ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’, ‘রাজকাহিনি’, ‘ভালোবাসার শহর’, ‘ঈগলের চোখ’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি ছবির মধ্য দিয়ে টালিগঞ্জেও অবস্থান বেশ পোক্ত করেছেন তিনি। কলকাতায় পেয়েছেন ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ইস্ট’ ও ‘সেরা বাঙালি’ পুরস্কার। এখন ঢাকা-কলকাতায়ই দিন কাটছে তার।