শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা
পোশাক শিল্প

দুশ্চিন্তায় মালিকরা

আট হাজার টাকা মজুরি দাবি শ্রমিকদের

দুশ্চিন্তায় মালিকরা
দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা। তাদের দাবি, এত নাজুক ক্রান্তিকাল ও বিপর্যয় আর কখনো আসেনি। সাভারে তাজরীন গার্মেন্টের অগ্নিকাণ্ডের বিপর্যয় সামলে ওঠার আগেই রানা প্লাজার ভবনধসে সারা বিশ্বে বাংলাদেশি পোশাকশিল্প মালিকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা। এ অবস্থায় বায়াররা অর্ডার দেওয়ার আগে জুড়ে দিচ্ছেন নতুন নতুন শর্ত। তবে শর্ত দিলেও পোশাকপণ্যের নামমাত্র দামও বাড়াতে চান না তারা। এর সঙ্গে রয়েছে গত সাড়ে তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ ছাড়া শ্রমিক-বিক্ষোভ, ব্যাংক-ঋণের চড়া সুদ, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ দরকারি অবকাঠামো সংকট ইত্যাদি তো আছেই। জানা গেছে, সাভারের রানা প্লাজার ভবনধসে হতাহতের ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে নাস্তানাবুদ পোশাকশিল্প মালিকরা। এ ঘটনায় নিহত এক হাজার ১২৭ জন ও শত শত আহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এ অবস্থায় আশুলিয়া এলাকায় ঘন ঘন শ্রমিক বিক্ষোভে বিপাকে পড়েছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। কেননা বিশ্বের বড় ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে যেসব কারখানা পরির্দশন করেন, এমন সব প্রতিষ্ঠানও রয়েছে আশুলিয়ায়। এসব প্রতিষ্ঠান ঘিরে শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে বিপাকে তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রানা প্লাজার ঘটনার পর ক্রেতারা নানা শর্ত দিচ্ছেন। অথচ তারা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য দিতে চান না। বিজিএমইএ ও পোশাকশিল্প মালিকদের মতে, গত ৩০ বছরের ইতিহাসে এত ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তারা হননি। গেল মার্চে পোশাকশিল্পে ১৯ শতাংশের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা বিগত দু-এক বছর আগের বাজারজাতকরণের ফসল। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি থেকে বাজারজাতকরণ প্রায় বন্ধ। এর সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি ক্রেতারাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। অব্যাহতভাবে পোশাকপণ্য হারাচ্ছে দর। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কারখানার বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, ব্যাংক সুদের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং উৎসে কর বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। পোশাকশিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক চাপের কারণে উদ্যোক্তারা ক্রেতাদের করুণার পাত্র হচ্ছেন। ক্রেতারা ইচ্ছানুযায়ী অর্ডার বাতিল করছেন। ঠিক সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করতে না পারলে ডিসকাউন্ট চাইছেন। সমুদ্রপথে শিপমেন্ট করতে না পারলে এয়ারফ্রেইট করতে বলছেন। আর এর মাশুল গুনতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। আকাশপথে শিপমেন্ট করলে খরচ বাড়ে ১২৮০ শতাংশ। এতে উদ্যোক্তাদের লাভ কমে, অনেক ক্ষেত্রে পুঁজিও গচ্চা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার উদ্যোক্তাসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পে নিয়োজিত প্রায় দুই কোটি শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কয়েক দিন পর পর হরতাল, নাশকতা ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হচ্ছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। ব্যাহত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন ও পণ্য বিপণন। পোশাকশিল্পের পণ্যসামগ্রী যথাসময়ে বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না। এর সঙ্গে নতুন যন্ত্রণা হিসেবে দেখা দিয়েছে রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী যানবাহন ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনা। ফলে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শ্রমিকরা যথেষ্ট আয় করতে পারছেন না। ফলে অনেক পোশাকশ্রমিক মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারে চলে যাচ্ছেন। এমনকি শুধু মরিশাসেই চলে গেছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। শ্রমিকরা বিদেশে চলে গেলে সুলভ শ্রমের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা পোশাকশিল্প কীভাবে টিকবে, এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্প একটি ঘূর্ণাবর্তের মুখোমুখি। এ অবস্থায় অর্থনীতিকে বাঁচাতে রাজনৈতিক অরাজকতা বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ও হরতালের কারণে বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের অন্যতম ক্রেতা বিশ্বের নামি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান ওয়াল-মার্ট ও ডিজনি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। আরেক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান 'এইচ অ্যান্ড এম' বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছে। ওয়াল-মার্ট বাংলাদেশি পোশাকপণ্য কেনার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পোশাকশিল্পে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। এ শিল্পের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। আমরা নিজ উদ্যোগে ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে পণ্যের রপ্তানি এখনো পর্যন্ত ঠিক রেখেছি।' বাংলাদেশ এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা অত্যন্ত চাপের মুখে আছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাভারে ভবনধসের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমদানিকারকদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। নূ্যনতম মজুরি আট হাজার টাকা দাবি : সাভারে রানা প্লাজার ভবনধসের পর দেশি-বিদেশি মহলের সমালোচনার মুখে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মালিক ও শ্রমিকরা। তারা বর্তমান বাজারব্যবস্থা ও জীবন-যাপনের ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে এবং খাদ্য-ক্যালোরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নূ্যনতম আট হাজার টাকা মজুরি দাবি করেছেন। এর আগে ২০১০ সালে মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। সে বছর ২৭ জুলাই নূ্যনতম তিন হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই মজুরি কাঠামোর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী অক্টোবরে। এরও আগে ২০০৬ সালে নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল এক হাজার ৬৬২ টাকা। পরে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে ২০১০ সালে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। যদিও তখন সরকার ও মালিক পক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রতি বছর বেতন বাড়ানো হবে। কিন্তু গত তিন বছরে এই প্রতিশ্রুতি সরকার ও মালিক পক্ষ কেউই রক্ষা করেনি বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। তথ্যমতে, বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর বাংলাদেশের প্রধান এই রপ্তানি খাতে ১৫ শতাংশ শ্রমিক-সংকট থাকার পরও প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান পোশাকশিল্পে। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন-যাপনের মৌলিক বিষয়গুলো নির্ভর করছে এই পোশাকশিল্প ঘিরে। পোশাকশিল্প শ্রমিকদের জীবন-যাপন ও দ্রব্যমূল্যের বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ঊধর্্বতন গবেষক, অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে দ্রব্যমূল্যের বাজারে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৪০ শতাংশ। এর সঙ্গে বেড়েছে তার বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ব্যয়। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তিনি নূ্যনতম মজুরি (চারজনের এক পরিবার ভিত্তিতে) নির্ধারণের পরামর্শ দেন। তার মতে, কমপক্ষে ৬০ শতাংশ মজুরি বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি প্রতি বছর যাতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মজুরি বাড়ানো হয় সে ব্যবস্থা মজুরি বোর্ডকে করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সাধারণ সম্পাদক, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সমন্বয়কারী ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, মজুরি বোর্ডের কাছে মূল দাবি হলো, পোশাকশ্রমিকদের নূ্যনতম বেতন আট হাজার টাকা করতে হবে। একই সঙ্গে চাল-ডাল ও তেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী রেশনিং করতে হবে। প্রতি বছর মূল্যস্ফীতির হার অনুযায়ী শ্রমিকদের মহার্ঘ্য ভাতা দিতে হবে। তিনি শ্রমিকদের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি করে আরও বলেন, শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, জীবনের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি শিরীন আখতার একজন শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য যে নূ্যনতম বেতন-কাঠামো দরকার, সেটুকুর নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য বোর্ডের প্রতি অনুরোধ জানান। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, এর আগের মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তিনি বাস্তবতার আলোকে আট হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরি দাবি করেন। মজুরি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, সরকার, মালিক ও শ্রমিক এ তিন পক্ষ মিলে নতুন মজুরি কাঠামো ঠিক হবে। ত্রিপক্ষীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নতুন মজুরি-কাঠামো হলে তা দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

সর্বশেষ খবর