শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা

শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাপী তোড়জোড়

বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে দেশের পোশাক শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। সাভার ট্র্যাজেডি ও তাজরীন দুর্ঘটনার পর এ ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও আইএলওসহ (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) এবং শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রেতাদের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে। এতে বিশ্বের বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি শ্রমিকদের কারখানা ভবন ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে সই করতে সম্মত হয়েছে। শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে বিজিএমইএ (পোশাক মালিকদের সংগঠন) সূত্রে জানা যায়, বিদেশি ক্রেতারা নিজ স্বার্থেই তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এমনকি 'ওয়াল মার্ট' ও 'গ্যাপ'-এর মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের যে কারখানাগুলো থেকে পোশাক ক্রয় করেন সেখানে প্রতিনিধি পাঠিয়ে নিজ উদ্যোগে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি নজরদারি করছেন। ইউরোপীয় ক্রেতারাও বাংলাদেশি বিক্রেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক বর্জনের হুমকি দিয়ে বিদেশি সাধারণ ক্রেতারাও এ বিষয়ে বড় ব্র্যান্ডগুলোকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় চাপের মুখে সম্প্রতি শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে শ্রম আইন ২০০৬ এর সংশোধনে উদ্যোগী হয়। বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের করুণ মৃত্যুবরণে কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলেও এ বিষয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের উদাসীনতায় শ্রমিক লাশের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। কিন্তু সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ভবন ও অগি্ন নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা ও মার্কিন সরকারের চাপের মুখে পড়ে তখন তারা নিজেরাই শ্রমিকদের নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে সম্মত হয়। এ উদ্দেশ্যে গত ২৯ এপ্রিল ওয়ালমার্ট এইচঅ্যান্ডএমসহ বিশ্বের ৪০টি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক করেছে। শ্রম সংস্থাগুলো এ সংক্রান্ত একটি সম্মিলিত আইন প্রচেষ্টায় সই করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দিচ্ছে। আগামী বুধবার এ চুক্তি সই করার শেষ দিন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (আইএলও), ট্রেড ইউনিয়ন এবং লবি গ্রুপগুলোর সঙ্গে ভবন ও অগি্ননিরাপত্তার সহায়তার জন্য ইউরোপের বড় ফ্যাশন চেইন ট্রান্স-আটলান্টিক সম্মত হয়েছে। সুইডেনের এইচ অ্যান্ড এম এবং স্পেনের ইনডিটেঙ্ এসএ'র মতো দুটি বড় অ্যাপারেল ব্র্যান্ডও চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে প্রিমার্ক ও সিঅ্যান্ডের মতো দুটি বড় প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া চুক্তি সই করেছে কেলভিন ক্লাইন, টমি হিলফিগার এর মালিক প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ। তবে চুক্তিতে মার্কিন কোম্পানি পিভিএইচ গ্রুপ সমর্থন জানালেও অন্য আর কোনো কোম্পানি সাড়া দেয়নি। সাড়া না দেওয়ার তালিকায় রয়েছে গ্যাপের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। গ্যাপ চুক্তির বিষয়ে আপত্তি না জানালেও আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করে। এ বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমাটের ভূমিকাও নিশ্চিত নয়। বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ক্রেতাদের সম্মিলিত প্রস্তাবটি এখনো তাদের হাতে এসে পেঁৗছায়নি। বিদেশি ক্রেতারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অনান্য সুবিধা প্রদানের জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। এমনকি গার্মেন্ট মালিকরাও বিজিএমইএর সঙ্গে নিজেদের কারখানার উন্নতির জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে ইউরোপীয় ক্রেতারা বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে শুরু করেছেন। তবে সাভারে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটনার পর বর্তমানে কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য মালিকরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। তবে বিদেশি ক্রেতাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো আভাস তিনি দেখছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। না হলে ক্রেতারা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শ্রম আইন-২০০৬ এ কিছু সংশোধন আনেন। এতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা, তাদের নিরাপত্তা ও বীমা সুবিধা, ৫ হাজার শ্রমিক হলেই সংশ্লিষ্ট কারখানার নিজস্ব ব্যয়ে ক্লিনিক সুবিধা ও কাজের সময় বহির্গমন পথ বন্ধ না রাখাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদিকে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির জন্য সম্প্রতি সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, ইতোমধ্যে তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে গার্মেন্ট শিল্পের জন্য একটি সূচক (ইনডেঙ্) তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। এর ফলে যে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য নিবে ও যারা তৈরি করবে তারা সূচকটি মেনে চলতে বাধ্য হবেন। ড. ইউনূসের মতে সূচকটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজন হবে। দেশের সব গার্মেন্ট মালিকদের এ সূচক মেনে কাজ করতে হবে। তবে এ জন্য আন্তর্জাতিক চাপের প্রয়োজন হবে। ড. ইউনূস জানান, এ নিয়ে টিআই'র সঙ্গে তার আলোচনা চলছে।

সর্বশেষ খবর