শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা

রহস্যের শেষ নেই সুখরঞ্জনকে নিয়ে

রহস্যের শেষ নেই সুখরঞ্জনকে নিয়ে
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের একটি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হয়েছিলেন পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি। হঠাৎ করে পক্ষ বদল করে তিনি হলেন অভিযুক্ত পক্ষের সাক্ষী। কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়ার নির্ধারিত দিনে তিনি অনুপস্থিত। তারপর সুখরঞ্জন নিরুদ্দেশ। সর্বশেষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া গেল। আর এ খবরে নতুন মাত্রা পেয়েছে সুখরঞ্জন রহস্য। সুখরঞ্জনকে ঘিরে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয় তার পক্ষ বদল নিয়ে। পক্ষ বদলের পর সাক্ষ্যদানে সুখরঞ্জনের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে ডালপালা ছড়ায় গুজবের। আসামির পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, অপহরণের দাবি নিছক একটি কল্পকাহিনী। এরপর যত দিন যায় সুখরঞ্জন রহস্য ঘনীভূত হয়। নানাজনে নানা কথা বলতে থাকেন। বলা হয়, সাক্ষী সুখরঞ্জন টাকার বিনিময়ে পক্ষ বদল করেছেন। বলা হয়, তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এও বলা হয় তিনি স্বেচ্ছায় প্রতিবেশী দেশে পাড়ি দিয়েছেন। মামলা শেষে রায় হলেও সুখরঞ্জন রহস্যের শেষ হয়নি। সুখরঞ্জন বালি নামটি যখন প্রথম শোনা যায় যখন তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভাইকে রাজাকার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। সেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সুখরঞ্জন বালি ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সাঈদীর নির্দেশে রাজাকার বাহিনী সুখরঞ্জনের ভাইকে গুলি করে বলে প্রমাণ হয়েছে যুদ্ধাপরাধ মামলায়। ট্রাইবুন্যালের তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পিরোজপুর থেকে ফিরে সুখরঞ্জনকে 'গুরুত্বপূর্ণ' সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু ২০১২ সালের অক্টোবরের শেষার্ধে বা নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় এসে সুখরঞ্জন হয়ে যান আসামি সাঈদীর পক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। গুজব ওঠে, অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়েছেন সুখরঞ্জন। ভাবা হয়, এ গুজবের সমাধান হবে যখন তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দেবেন। কারণ সর্বশেষ তালিকায়ও তিনি সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষী দেবেন এমন তথ্যই ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়। কিন্তু গত ৫ নভেম্বর পল্টনে জামায়াত নেতা ও আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের অফিস থেকে বেরিয়ে অদূরবর্তী ট্রাইব্যুনাল চত্বরে যাওয়ার পর বা যাওয়ার আগেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে খুঁজে বের করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাইকোর্টে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চে রিট আবেদনও করা হয়। পরে সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, সুখরঞ্জন বালি তার সঙ্গে গাড়িতে করে আসছিলেন। সে সময় প্রায় ১৫ জন পুলিশের সামনে থেকে সাদা পোশাকধারী লোকেরা বালিকে তার গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় জামায়াত নেতার পক্ষের আইনজীবীরা সেদিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচার কার্যক্রম বর্জনও করেন। সেই থেকেই সুখরঞ্জন নিখোঁজ ছিলেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের অপহরণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, অপহরণের দাবি একটি কাল্পনিক নাটক। সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকার ইংরেজি দৈনিক নিউএজে এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সুখরঞ্জন 'বালা' নামে ভারতে দমদম সংশোধন হোমে এক বাংলাদেশি আছেন যিনি সেই সুখরঞ্জন 'বালি'। বালা ও বালি'র পার্থক্য হয় ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চারণগত ভুলের কারণে। এ বিষয়টি নিয়ে সে দিনই তৎপর হয় সংবাদ সংস্থা বিবিসি ও মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বিবিসির খবরে বলা, অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে উত্তর চবি্বশ পরগনার স্বরূপনগর এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২৩ ডিসেম্বর রাতে এক বাংলাদেশিকে আটক করে বিএসএফ। বিএসএফ ওই ব্যক্তিকে স্বরূপনগর থানার হাতে তুলে দেয়। পরে তাকে বসিরহাট আদালতে দাখিল করে থানা পুলিশ। আদালতের নথি অনুসারে ওই ব্যক্তির নাম সুখরঞ্জন বালা, পিতার নাম প্রয়াত ললিত রঞ্জন বালা, গ্রাম পাড়ারহাটি, থানা গঙ্গারামপুর, জেলা পিরোজপুর, বাংলাদেশ। ধারণা করা হচ্ছে, আদালতে নাম নথিভুক্ত করার সময় বালির স্থানে ভুলবশত বালা লেখা হয়। পর দিন তাকে আদালতে তোলা হলেও সেই মামলার রায় হয় চলতি বছরের ৩ এপ্রিল। তার ২০ দিনের সাজা হয় যা তিনি ইতোমধ্যেই ভারতীয় কারাগারে কাটিয়েছেন। এখন কলকাতার দমদম কারাগারে আছেন সাজার মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি হিসেবে। নিউএজের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সুখরঞ্জন বালি ভারতে কারাগার থেকে তাদের কাছে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এই বিবৃতিতে তাকে অপহরণের কথিত ঘটনা এবং কীভাবে তাকে ভারতে পাঠানো হয়েছে তার বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কারা বিভাগের প্রধান রণবীর কুমার বিবিসির কাছে দাবি করেন, 'ভারতের জেলে থাকা কোনো বাংলাদেশি বন্দীর সঙ্গে দেখা করে তার বিবৃতি নেওয়া এবং সেই বিবৃতি কোনে বিদেশি কাগজের হাতে পেঁৗছে যাওয়াটা অসম্ভব। তার কোনো আত্দীয়ও যদি বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন, তাহলে সাক্ষাৎ প্রার্থীর পাসপোর্ট ও ভিসা পরীক্ষা করে রেকর্ড রাখা হয়। তার হাতে বন্দী কর্তৃক কোনো কাগজের টুকরো দেওয়াটা অসম্ভব।' কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যের পরও বিবিসির পক্ষ থেকে সূত্রের বরাতে বলা হয়, দমদম কারাগার কর্তৃপক্ষ বিবৃতির বিষয়ে বালিকে জেরা করেছেন। বালি তখন স্বীকার করেছেন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এক কারারক্ষীর মাধ্যমে চিঠি বা বিবৃতিটি তিনি পাঠিয়েছেন। সেই কারারক্ষী চিঠিটি নিজেই সীমান্ত এলাকায় গিয়ে এক চোরাচালানিকে দিয়েছেন। সেখান থেকে পত্রিকা পেয়ে থাকতে পারে। বিবিসির দাবি, কারা কর্তৃপক্ষ সেই কারারক্ষীকে চিহ্নিত করে শাস্তির প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। তবে বিবিসির এ বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি ভারতের একাধিক গণমাধ্যম। সর্বশেষ খবর অনুসারে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া বালিকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশইন করার চিন্তা করছে বিএসএফ। বিষয়টিতে আপাতদৃষ্টিতে গুজব বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ও ভারতীয় কূটনীতিকরা। নাম না প্রকাশের শর্তে এক কূটনীতিক গতকাল রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় কোনো বিদেশিকে ফেরত পাঠাতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া লাগায় বিএসএফ পুশইনের মতো কাজ আগেও করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেই ভিত্তিতে তাকে পুশইনের কথা আসতে পারে। তবে সুখরঞ্জন বালা যদি সেই সুখরঞ্জন বালি হয়ে থাকেন তাহলে তার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়মের ব্যতিরেকে কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। সংবেদনশীল কোনো ইস্যুতে ব্যতিক্রম হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কোনো রাষ্ট্রই এ ঝুঁকি নেবে না যেখানে নিয়মমাফিক বন্দীবিনিময় বা সাজার মেয়াদোত্তীর্ণদের ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া আছে। অন্যদিকে, সুখরঞ্জন বালির বিষয়টি গত দুই দিনের আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কলকাতার ডেপুটি হাইকশিনকে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। ডেপুটি হাইকমিশনের এক পদস্থ কূটনীতিক গতকাল কলকাতা থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ডেপুটি হাইকমিশনের পক্ষ থেকে নিজ উদ্যোগে এ বিষয়ে তথ্য নিশ্চিত হতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি মন্তব্য করেন, 'তথ্যের অভাবে বিষয়টিকে সত্যও বলতে পারছি না, মিথ্যা বলেও উড়িয়ে দিতে পারছি না। এখনো রহস্যের মধ্যেই আছি।'

সর্বশেষ খবর