সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

আলোচিত টিকফা সই সেপ্টেম্বরে

চুক্তিতে রয়েছে ১৬ প্রস্তাবনা ৭ অনুচ্ছেদ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ফোরাম গঠনে বহু আলোচিত টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট) চুক্তিটি সই হবে আগামী সেপ্টেম্বরে। গত ২৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল বি ফ্রম্যানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লেখা ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের এক চিঠিতে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। দূতাবাসের লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে ঢাকা অথবা ওয়াশিংটনে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল বি ফ্রম্যান এতে স্বাক্ষর করবেন। তবে ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষর হলে এ উপলক্ষে ঢাকায় আসতে পারেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। আর ওয়াশিংটনে হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, চুক্তির ডকুমেন্ট ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়েল ভেটিং শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর আগে টিকফা চুক্তির খসড়া গত মাসে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে টিকফা চুক্তির ইংরেজি কপি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে চুক্তির বাংলা ভার্সনসহ একটি চিঠিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য সময়ে চুক্তি সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে টিকফা চুক্তির বাংলা ভার্সনের একটি কপি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর হাতে এসেছে। ইংরেজির অনুকরণে গত ৭ জুলাই বাংলা ভার্সনটি চূড়ান্ত করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইংরেজি চুক্তিপত্রের বাংলা অনুবাদ করেছে।

চুক্তিপত্রে বাংলায় শিরোনাম দেওয়া হয়েছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম গঠন সংক্রান্ত চুক্তি।' শিরোনামটি ৪ লাইনে বিন্যাস করা হয়েছে। চুক্তি সইয়ের স্থান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির সন, মাস ও তারিখের ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছে।

বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চুক্তিপত্র তৈরি হলেও এখনো দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়নি। স্থানের বিষয়টিও চূড়ান্ত নয়। দুই পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে ঢাকা কিংবা ওয়াশিংটন যে কোনো জায়গায় চুক্তি হতে পারে। তিনি বলেন, টিকফা চুক্তি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সম্পাদন হবে। এক্ষেত্রে দুটি ভার্সনই চুক্তির ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব পাবে।

টিকফা চুক্তিতে যা আছে : টিকফা চুক্তিতে মোট ১৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত একটি প্রস্তাবনা ও ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রথম প্রস্তাবনায় উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন ও সহযোগিতার মনোভাব দৃঢ় করা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ২য় প্রস্তাবনায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ৩য় প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে উভয়পক্ষ উপকৃত হতে পারে। তবে বাণিজ্য বিঘ্নকারী বিনিয়োগ কার্যক্রম এবং বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ও সংরক্ষণমূলক বাণিজ্য ব্যবস্থা এই উপকারকে সংকুচিত করতে পারে বলে একই প্রস্তাবনায় স্বীকার করা হয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ কনভেনশনে উভয়পক্ষের সই করার বিষয়টি উল্লেখ করে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং এই কনভেনশনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে স্বচ্ছতার কথা বলা হয়েছে তার গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে ৪র্থ প্রস্তাবনায়। প্রবৃদ্ধি অর্জনে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, বাণিজ্য সম্প্রসারণে, প্রযুক্তির বিকাশে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বেসরকারি বিনিয়োগের অপরিহার্যতা স্বীকার করা হয়েছে ৫ম প্রস্তাবনায়। ৬ষ্ঠ প্রস্তাবনায় উভয় দেশের অর্থনীতিতে সেবা-সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে শুল্কবহির্ভূত প্রতিবন্ধকতা কমানোর বিষয়টি বলা হয়েছে ৭ম প্রস্তাবনায়।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডবি্লউটিও) এর ট্রিপস চুক্তি, বার্ন কনভেনশন এবং মেধা সম্পদ সংরক্ষণ (আইপিআর) সংক্রান্ত অন্য যে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির বিধান পক্ষদ্বয়ের জন্য যেভাবে প্রযোজ্য সেভাবে অনুসরণ এবং পর্যাপ্তভাবে ও সঠিক পন্থায় মেধাসম্পদ সংরক্ষণ ও এর অধিকার বলবৎকরণের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে ৮ম প্রস্তাবনায়।

৯ম প্রস্তাবনায় অর্থনৈতিক কল্যাণে শ্রম অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের গুরুত্ব স্বীকার করে বলা হয়েছে উভয় পক্ষ তাদের আইনে ও অনুশীলনে আইএলও 'ডিক্লারেশন অন ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপালস অ্যান্ড রাইটস এট ওয়ার্ক অ্যান্ড ইটস ফলো-আপ (১৯৯৮)'-এ বর্ণিত মৌলিক শ্রম অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন, এটি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিজ নিজ আইনে কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করবে।

উভয় পক্ষের পরিবেশ আইন অনুসরণে পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের গুরুত্ব স্বীকার করে এটি নিশ্চিত করার অভিপ্রায় এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বাণিজ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি পরস্পরের সহায়ক হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ১০ম প্রস্তাবনায়। ১১শ প্রস্তাবনায় একপক্ষ অন্য পক্ষ্যের ভূ-খণ্ডের শিল্পোদ্যোগ এবং অন্যান্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগকে উৎসাহিত ও ত্বরান্বিত করার বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে পরের প্রস্তাবনায়। ১৩শ প্রস্তাবনায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি অক্ষুণ্ন রেখে পারস্পরিক সুবিধাজনক চুক্তির মাধ্যমে ডবি্লউটিও এর নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে জোরদার করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ডবি্লউটিও-এর সদস্য হিসেবে উভয় দেশ সংস্থাটির চুক্তির সঙ্গে বা এর আওতায় সম্পন্ন চুক্তি, সমঝোতা এবং অন্যান্য দলিলে বিধৃত অধিকার ও দায়বদ্ধতা কোনোভাবে ক্ষুণ্ন করবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ১৪শ প্রস্তাবনায়। এই চুক্তি ১৯৮৬ সালের ১২ মার্চ দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত পুঁজি বিনিয়োগ চুক্তির কোনো অধিকার বা দায় ক্ষুণ্ন করবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫শ প্রস্তাবনায়। সবশেষ প্রস্তাবনায় বর্ধিত সহযোগিতা এবং আরও বিশদ চুক্তির মাধ্যমে উভয়পক্ষ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে এই চুক্তির মাধ্যমে আর আলোচনা এবং একটি ফলপ্রসূ ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে বলে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে।

আলোচ্য ১৬টি প্রস্তাবনা দিয়ে আরও ৭টি আর্টিকেল (অনুচ্ছেদ) যুক্ত করা হয় চুক্তিতে। এ বিষয়গুলোতে উভয় দেশ সম্মত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। অনুচ্ছেদ এক-এ বলা হয়েছে, উভয় দেশ আকর্ষণীয় বিনিয়োগের পরিবেশ বিকাশে দৃঢ়ভাবে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে পণ্য ও সেবাভিত্তিক বাণিজ্যের প্রসার ও বহুমুখিতা আনতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ফোরাম প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে ২ নম্বর অনুচ্ছেদে। এখানে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভের (ইউএসটিআর) সদর দফতর নিজ নিজ পক্ষে সভাপতিত্ব করবে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে উভয় পক্ষকেই অন্যান্য সরকারি দফতরের কর্মকর্তারা সহযোগিতা করতে পারবেন। ২ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর উপধারায় ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠান এবং আলোচনায় বসার স্থান ও সময় নির্ধারণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে বছরে কমপক্ষে একবার বৈঠক করার কথা বলা হয়েছে। ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ফোরাম সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের সুযোগ চিহ্নিত এবং তদারকির কথা বলা হয়েছে ১ নম্বর উপধারায়। নির্দিষ্ট কোনো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে উভয় পক্ষের আগ্রহ বিবেচনায় নেওয়ার কথা রয়েছে ২ নম্বর উপধারায়। পরের উপধারায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা দূর করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের সর্বশেষ উপধারায়। ব্যবসা ও বিনিয়োগের বিষয়ে যে কোনো দেশ লিখিতভাবে সবিস্তারে প্রস্তাব দিলে ফোরাম তা দ্রুত আমলে নেবে। এক পক্ষের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধায় ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে এমন কোনো কাজ অন্যপক্ষ করার আগে সেটা বিবেচনায় আনার জন্য ফোরামকে সুযোগ দেওয়া হবে। এ দুটি বিষয় রয়েছে ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে।

যে কোনো দেশের অধিকার, বাধ্যবাধকতা বা সুবিধাগুলো এই চুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না বলে স্পষ্ট করা হয়েছে ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে। ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে এ কথা বলা হয় : উভয় দেশ চুক্তি বাস্তবায়নের অভ্যন্তরীণ সব প্রক্রিয়া শেষ করার ঘোষণা দেওয়ার পর এটি কার্যকর হবে। যদি উভয় পক্ষ এ বিষয়ে একই দিনে নিজেদের লিখিত জানান না দেয়, তবে সর্বশেষ যে তারিখে একপক্ষ অপরপক্ষকে অবহিত করবে সে তারিখ থেকে চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। সর্বশেষ ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে চুক্তি বাতিলের বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, উভয় দেশ লিখিত নোটিস দিয়ে এ চুক্তি বাতিল করতে পারবে। যেই তারিখে উভয় দেশ বাতিলের বিষয়ে একমত হবে সেই তারিখে এটি কার্যকর হবে। যদি উভয় দেশ একমত না হতে পারে তাহলে নোটিস দেওয়ার ১৮০ দিন পর চুক্তি বাতিল হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর