সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

সামিট গ্রুপের মর্জিতেই চলছে বিদ্যুৎ বিভাগ

সামিট গ্রুপের মর্জিতেই চলছে বিদ্যুৎ বিভাগ

সামিট গ্রুপের মালিক আবদুল আজিজ খানের মর্জিতেই চলছে বিদ্যুৎ বিভাগের কার্যক্রম। আইনের চেয়ে তার কথাই এখানে বড় বিষয়। দফায় দফায় আইন লঙ্ঘন করলেও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না তার বিরুদ্ধে। কথিত আছে, মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও নাকি সমীহ করে চলেন তাকে। খবর বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। সামিট গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন সামিট পাওয়ার লিমিটেড। কোম্পানিটি বিবিয়ানায় ৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ পায় ২০১১ সালে। এত দিনে কেন্দ্রটির উৎপাদন শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও নির্মাণকাজই শুরু করতে পারেনি সামিট।

অন্যদিকে কাজটি বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বানেরও সাহস পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। সামিট কাজ শুরু না করার কারণ হিসেবে 'অর্থের ব্যবস্থা হয়নি' বলে অজুহাত দেখিয়ে চলেছে। কিন্তু এ অজুহাত সম্পূর্ণ বেআইনি। এ যুক্তিতে চুক্তি টিকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র। সামিট পাওয়ার প্রসঙ্গে পিডিবির পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, 'বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একটি আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট)। এখানে সরকারের অর্থায়নের কোনো দায় থাকে না। অর্থায়ন কীভাবে হবে, কোন কোম্পানি থেকে মালামাল আনা- এসব নিশ্চিত করেই দরপত্রে অংশ নেওয়ার কথা। এটাই বিধান।' তিনি বলেন, অর্থায়ন কোন ফান্ড থেকে হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করে দরপত্রের ঘোষণা দিতে হয়। তাহলে আজ সামিটের দফায় দফায় সময় দেওয়ার অর্থ কী দাঁড়ায়। মূলত সরকার তাদের এই জামানত বাতিল করতে চায় না। আর এর সাহসও রাখে না। বিডি রহমতউল্লাহ দাবি করেন, বরং দরপত্রে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়ার জন্য শাস্তি হতে পারে সামিটের। আইন অনুযায়ী সামিট পাওয়ারের চুক্তি বাতিল ও তাদের ৩০ লাখ ডলার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাইয়ের কোম্পানি হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ সামিটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছে না। নজিরবিহীনভাবে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে নিচ্ছে কোম্পানিটি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ শুরুর জন্য ৩১ মার্চ পর্যন্ত চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ও শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগে। চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন পাওয়ার সেলের তৎকালীন মহাপরিচালক মাহবুব সারোয়ার ই-কায়নাত। তিনি সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত করার জন্য জোর সুপারিশও করেছিলেন। কথিত আছে, এ কারণেই নাকি তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তা না হলে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ আরও বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। বিডি রহমতউল্লাহ দাবি করেন, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সামিটকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সরকার এটি কোনোভাবেই করতে পারে না। বিদ্যুৎ খাতে এটি একটি কলঙ্কতিলক হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে আর কোনো কোম্পানি এ রকম আইন অমান্য করলে নৈতিকভাবে কিছুই করার থাকবে না। এমনকি এ বিষয়টি উদাহরণ টেনে মামলা ঠুকে দিলেও আটকে যাবে বিদ্যুৎ বিভাগ।

২২ জুলাই বৃহৎ ?আইপিপিগুলোর (যার আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি) নির্মাণ অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে বৈঠকে বসে বিদ্যুৎ বিভাগ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম। সেখানে সামিট পাওয়ার প্রতিনিধিকেও ডাকা হয়। কিন্তু এ বৈঠকেও কবে কাজ শুরু করবে নির্দিষ্ট করে তা বলতে পারেনি সামিট।

সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং সামিটকে নিয়ে বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি জানান, যেহেতু বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই বিষয়টি ওউন না করলে সম্ভব নয়। আইনানুগ ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না, আর কেনই বা সামিটের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে- এমন প্রশ্নে পাওয়ার সেলের ডিজি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কবে এ বৈঠক হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টার শিডিউল পেলেই বৈঠকটি করা হবে। বিষয়টি বিদ্যুৎ খাতের কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে বলেও স্বীকার করেন মোহাম্মদ হোসাইন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সামিটকে নিয়ে আবার বসতে হবে। সেখানেই নেওয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।' চুক্তি ভঙ্গ করেছে কিন্তু এর পরও কেন সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে সচিব জানান, চুক্তি বাতিল করলেই তো সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে না। নতুন করে দরপত্র করতে গেলে তো আরও অনেক সময় লেগে যাবে। তাই সামিটকে দিয়েই কাজটি করাতে চাইছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ সচিবের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পিডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামিট ফেল করার পর বিদেশি একটি কোম্পানি অভিন্ন শর্তে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ সাড়া দেয়নি। সামিটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে আছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তিনি বলেন, এত দিন হয়তো চুক্তি বাতিল করা হতো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে সামিটের জামানত নিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি বাতিল হলে জামানত ৩০ লাখ ডলার সামিটকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সামিটকে পিডিবির বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে তার? জামানত বাজেয়াপ্ত করতে না হয়। কিন্তু সামিট নাকি মামলা করতেও সম্মত হয়নি। এতে নাকি কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।

গ্যাসভিত্তিক এ কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২ দশমিক ৬৬ টাকা দরে কেনার কথা সরকারের। অন্যদিকে তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ পেতে ভাড়াসহ প্রতি ইউনিটের দর পড়ছে প্রায় ২০ টাকার মতো। এ কেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দিতে পারত সরকার। সারা দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সরকার মুনাফা করতে পারত। অথচ এখন সেখানে প্রতি ইউনিটে ঘাটতি যাচ্ছে প্রায় ১৫ টাকার মতো।

পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূলত কুইক রেন্টাল ব্যবসা জিইয়ে রাখার জন্য সামিট ইচ্ছা করেই এমন আচরণ করছে। তারা নিজেরাও করছে না, আবার কাজটি ছেড়েও দিচ্ছে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে বেশ কয়েকটি কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। আর বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ঝুলিয়ে রেখেছে সামিট। এর পেছনে কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। এদিকে সামিটের বিবিয়ানা-১-এর সঙ্গে একই দিন আরও দুটি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করা হয় সামিটের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে একই ক্ষমতার বিবিয়ানা-২ ও মেঘনাঘাট ৩৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট। মেঘনাঘাট চলতি বছরের অক্টোবরে উৎপাদনে আসার কথা। নির্দিষ্ট সময়ে আসতে পারছে না এ কেন্দ্রটিও। আর বিবিয়ানা-২ চলতি বছরের মাঝামাঝিতে এসে কাজ শুরু করেছে। বর্তমান সরকারের সময় উপাদনে আসতে পারছে না কেন্দ্রটি।

নতুন ও পুরনো মিলিয়ে সামিট গ্রুপ বর্তমানে ৩১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এগুলো হচ্ছে সাভার_ ৪৫, চান্দিনা- ২৫, মাধবদী-৩৫, রূপগঞ্জ- ৩৩, মাওনা- ৩৩, জাঙ্গালিয়া- ৩৩, মদনগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)- ১০২ এবং উল্লাপাড়া- ১১ মেগাওয়াট। এর বাইরে অংশীদারির ভিত্তিতে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) উৎপাদন ১০০ থেকে বাড়িয়ে এখন ২৬৫ মেগাওয়াট করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কথা বলতে অনেক চেষ্টা করেও সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

 

সর্বশেষ খবর