সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

বর্ষায় বিপর্যস্ত রাজধানী

ওয়াসার ভঙ্গুর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাই দায়ী

বর্ষায় বিপর্যস্ত রাজধানী

শনিবার সারা রাত ও গতকাল দিনভর কখনো মুষলধারায়, কখনো থেমে থেমে চলা বৃষ্টিতে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলসহ ব্যাপক এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির। অনেক এলাকার প্রধান রাস্তা, শাখা রাস্তা, অলিগলি একহাঁটু পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। ড্রেন-ডাস্টবিন, নর্দমা, স্যুয়ারেজে একাকার অবস্থায় জিম্মি হয়ে পড়েছে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার মানুষ।বৃষ্টিপাতের কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েন ঈদ বাজারে আসা ক্রেতারা। রাস্তায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও কোনো যানবাহন যেমন পাওয়া যাচ্ছিল না, তেমনি পানিবন্দী সড়কগুলোয় ভয়াবহ যানজটে আটকে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী। কুড়িল-রামপুরা, সায়েদাবাদ-শনিরআখড়া, আগারগাঁও-মিরপুর-পল্লবী, পুরান ঢাকার বেশির ভাগ রাস্তায় হাঁটু পানি জমে ওঠায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িগুলো আটকে থাকে। কর্মজীবীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। বিরামহীন বর্ষণে রাজধানীর অনেক রাস্তাঘাট, ফুটপাতসহ নিচু এলাকায় পানি জমে যায়। বেড়ে যায় জনদুর্ভোগ। বৃষ্টিতে আটকা পড়ে হাজার হাজার মানুষ। নিকটস্থ শপিং মল, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয় লোকজন। অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় রিকশা, অটো সিএনজি ও ট্যাঙ্কি্যাবের ভাড়া। নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল ও আশপাশের অনেক স্থানেই ছিল হাঁটু পানি। নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কারণে কাদা-পানি মিলিয়ে বিপজ্জনক পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে ব্যস্ততম যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান ও কুড়িল এলাকা। বৃষ্টির মাত্রা বেশি থাকায় দৌড়াদৌড়ি করে পাবলিক বাসে ওঠাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি অনেকের। আর বৃষ্টি শেষ হলে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। রাস্তা ও ফুটপাতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। বৃষ্টিপাতের কারণে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে বন্দী হয়ে যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, কদমতলী, মুগদা, সবুজবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত, দক্ষিণখান, ভাটারা, ভাসানটেক ও পল্লবী-কাফরুলের বিভিন্ন মহল্লায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হয়।

পুরান ঢাকার শ্যামপুর, ডেমরা, কাজলা, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মানিকনগর, মুগদা, মান্ডার নিচু এলাকাগুলোর জলাবদ্ধতা যেন কাটছেই না। স্থানীয়রা অতিষ্ঠ হয়ে কাস্তে কোদাল নিয়ে নিজেরাই পানি অপসারণে নানা স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না। নানা চেষ্টা সত্ত্বেও ওইসব স্থানের জলাবদ্ধতা হাঁটুর নিচে নামানোই যাচ্ছে না। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেই ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার কোনো রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলাচলের উপায় থাকে না। খানাখন্দগুলো ডিঙিয়ে, নোংরা পানিতে পা চুবিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে হয়। ভাঙা ড্রেন-নর্দমা-পানিতে একাকার হওয়ায় উল্টে যায় রিকশা, সিএনজি। পথচারী, যাত্রীরা আঘাতপ্রাপ্ত হন প্রায়ই।

রাজধানীর নিম্নাঞ্চল বিশেষ করে জুরাইন, শ্যামপুর, নামাপাড়া, বালুর মাঠ, মুরাদপুর, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, কদমতলী, পলাশপুর, জিয়া সরণি, মোহাম্মদপুর-বেড়িবাঁধ, নন্দীপাড়া, ত্রিমোহনী, বরপা, জোড়াভিটা, লায়নহাটি, কাজলা, মোহাম্মদপুরের হাজী সালাম সরদার রোড, বেড়িবাঁধ ও বউবাজার এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে মারাত্দক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে আদাবর, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সরু গলিতেও পানি জমেছে। পুরান ঢাকার বনগ্রাম, শশীমোহন বসাক লেন, উত্তর মৈশুন্ডির অনেক রাস্তার অবস্থা আরও শোচনীয়। গুলশানে মার্কিন দূতাবাসঘেঁষা ভাটারা থানা পেরিয়ে পুবদিকে দুই কদম এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সেখানে সম্প্রসারিত সৌদি দূতাবাসের চারপাশজুড়েই কাদা-পানির বেহাল পরিস্থিতি। প্রতিটি রাস্তায় পানি জমে আছে। সেসব স্থানে খোলা ড্রেনগুলো নিমজ্জিত হওয়ায় পানির মধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গলিজ পদার্থ।

নূরেরচালা এলাকার বাসিন্দা মো. সবুজ বলেন, লক্ষাধিক অধিবাসী অধ্যুষিত নূরেরচালার সব রাস্তা, অলিগলি জলাবদ্ধ হয়ে আছে। বরং নোংরা পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা-উচ্ছিষ্ট পচেগলে কদাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর ওপর আবার চার দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি চরম খারাপ আকার ধারণ করেছে।

আবর্জনার বিপর্যয় : জলাবদ্ধতার সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা, তরল বর্জ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। নগরীর মারাত্দক জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত মহল্লাগুলোয় প্রায় দেড় হাজার ডাস্টবিন ও ৫০টিরও বেশি ডিমাউন্ট্যাবল কন্টেইনার ডাস্টবিন ডুবে যাওয়ায় আরও মারাত্দক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আবর্জনার মাখামাখিতে পানি নিকষ কালো বর্ণে পরিণত হয়েছে এবং উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ডাস্টবিনগুলো দ্রুত স্থানান্তর ও ভাসমান আবর্জনা সংগ্রহের ব্যাপারে সিটি করপোরেশন আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে অস্বাস্থ্যকর ও পরিবেশ বিপন্নতার মুখে পড়েছেন বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানি ও ড্রেনের মধ্যে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনায় স্ট্রমস্যুয়ারেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিরপুর, পল্লবী ও কাফরুলে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। স্যুয়ারেজ লাইনের পাইপ নির্মাণের জন্য ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে অনেক এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা, ট্যাঙ্কি্যাব এবং রিকশা চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টিতে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কোথাও ভারী আবার কোথাও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী জেলার সর্বত্রই কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। গভীর রাতে কুয়াকাটায় ভারী বর্ষণ হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপকূলে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে টানা বর্ষণে পটুয়াখালীর নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমির পাশাপাশি রাস্তাও তলিয়ে গেছে পানিতে। সব মিলিয়ে থমকে আছে পটুয়াখালীর জীবনযাত্রা। নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশালে চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে গতকাল রবিবার দিনভর। প্রবল বৃষ্টির ফলে বরিশালের জনজীবন ছিল প্রায় অচল। দিনভর কখনো ভারী, কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে নগরীর প্রধান সড়কগুলো হাঁটুজলে ডুবে যায়। এদিকে দিনের শুরুতে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঈদ বাজারে নগরীর বিপণিবিতানগুলো ছিল ক্রেতাশূন্য। সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফটকের অর্ধেক বন্ধ ছিল। অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে বিক্রয়কর্মীদের।

ওয়াসার ভঙ্গুর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাই দায়ী : ঢাকা ওয়াসার ভঙ্গুর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার কারণেই প্রতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীজুড়ে বিপর্যয় নেমে আসে। সামান্য বৃষ্টিপাতেই নগরীর সিংহভাগ এলাকায় হাঁটুপানি জমে মারাত্দক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নগরীর পয়ো ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসার গড়ে তোলা ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। রাজধানীতে পয়োনিষ্কাশন লাইন রয়েছে ৮৮১ কিলোমিটার যা মোট চাহিদার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেটুকু ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল সেগুলোর বেশির ভাগই অচল, ময়লা-আবর্জনায় আবদ্ধ। কদমতলা, বাসাবো, সবুজবাগের অনেক মহল্লায় ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙেও অনেকে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন। তারা ভরাট করে দিয়েছেন ওয়াসার সচল ড্রেন ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাও। কিন্তু জবর-দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা বদ্ধ ড্রেন সচল করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় এসব কালভার্টে পাঁচ থেকে আট ফুট কঠিন বর্জ্য জমে গেছে। প্রায় বন্ধ হতে চলেছে বর্জ্য নিঃসরণের পথ। কালভার্টের ভেতরে জমেছে বিষাক্ত গ্যাস। সেগুনবাগিচা বঙ্ কালভার্ট গভীরতায় ১২ ফুট এবং প্রস্থ ১৪ ফুট। ড্রেনেজ বিভাগের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ১২ ফুট গভীরতার মধ্যে প্রায় আট ফুটই কঠিন বর্জ্য জমে বন্ধ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর জমেছে পলিথিন। ওই বর্জ্য এখন এতটাই শক্ত হয়ে গেছে যে, ওয়াসার সাধারণ কাটার মেশিন দিয়ে তা কাটা সম্ভব হচ্ছে না। এখনো খোলা থাকা বাকি মাত্র চার ফুট পথে সীমিতভাবে বৃষ্টির পানি অপসারিত হচ্ছে।

নিশ্চিহ্ন খাল, অভিশপ্ত বঙ্ কালভার্ট : জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, তরল ময়লা নিষ্কাশন ও খালগুলোকে নানামাত্রায় ব্যবহারের লক্ষ্যে ওয়াসা ১৯৯৬ সালে এ বঙ্ কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। ব্যয় করা হয় ২০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় সেগুনবাগিচা খাল (সেগুনবাগিচা-ফকিরাপুল-মতিঝিল-দক্ষিণ কমলাপুর), ধলপুর খাল (উত্তর সায়েদাবাদ-ধলপুর-মানিকনগর-মুগদা-কদমতলা) খাল বঙ্ কালভার্টে পরিণত করার কাজ শুরু করে। এসব বঙ্ কালভার্ট নির্মাণের সময় বলা হয়, এসব খালের বহুমুখী ব্যবহার হবে। কালভার্টগুলোর ভেতর দিয়ে সহজেই পানি নিষ্কাশন হবে এবং উপর পাশটা ব্যবহার হবে রাস্তা হিসেবে।

খালগুলো ধ্বংস করে কোটি কোটি টাকার বঙ্ কালভার্টগুলো এখন নগরবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বঙ্ কালভার্ট অর্ধনির্মিত অবস্থায় ১৫-১৬ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে কালভার্টের বেশির ভাগ অংশই জবরদখল হয়ে গেছে। বঙ্ কালভার্টের কংক্রিট দেয়ালে ঠেস দিয়েই গড়ে উঠেছে দখলবাজদের বাড়িঘর, স্থাপনা। বঙ্ কালভার্টের ওপর টিনচালা আর বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো হয়েছে রিকশা গ্যারেজ, গরুর গোয়ালঘর, ঝুপড়ি বস্তি। অবৈধ দখলদাররা তাদের ইমারত নির্মাণ করতে খালের বিভিন্ন পয়েন্ট ভরাট করেছে। ফলে পানি প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্ কালভার্ট উপচে পড়া তরল ময়লায় সয়লাব থাকছে চারপাশ, সেসব ঢুকে পড়ছে আশপাশের বাড়িঘরেও।

নগর কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সময়ের ব্যবধানে আরও বেশ কয়েকটি সচল খালকে সড়কে পরিণত করা হয়েছে। অনেক খাল ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে আছে। রাজাবাজার খাল, ধোলাই খাল-১, ধোলাই খাল-২, শাহজাহানপুর খাল, গুলশান বনানী খাল, ধানমন্ডি খাল, দক্ষিণগাঁও-নন্দীপাড়া খাল, রাজারবাগ-নন্দীপাড়া খাল, নাসিরাবাদ-নন্দীপাড়া খালের অস্তিত্ব কেবলই ময়লা-আবর্জনায় ভরাট ভাগাড়ে পরিণত। এ ছাড়াও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল, ডুমনি খাল, বাউখার খাল এবং গোবিন্দপুর খালসহ ১৩টি খাল শুধু নামেই আছে, বাস্তবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

অস্তিত্বহীন জলাভূমি : শুধু সচল খালগুলোই নয়, নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে রাজধানীর সব জলাভূমি। পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর। বড় বড় বিল-ঝিল ঘিরে আছে বস্তির দখলদারিত্ব। জলাধারগুলো নিশ্চি??হ্ন হওয়ায় সামান্য বৃষ্টির পানিও বুকে ধারণ করার মতো বিল-ঝিলের অস্তিত্ব নেই। এমনকি প্রতিদিন নগরীতে জমে ওঠা তরল ময়লা, বর্জ্য অপসারণের পথ না থাকায় তা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, উৎকট দুর্গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। কোথাও এক চিলতে পরিচ্ছন্ন জলাভূমি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বত্রই নোংরা আবর্জনায় পূর্ণ হতশ্রী ডোবানালার অবস্থান। সামান্য বৃষ্টিপাতেই এসব নোংরা ডোবা উপচে তরল ময়লা আর পানিতে আশপাশের মহল্লাগুলো জলবন্দী হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ জলাশয়ই প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থা জবরদখল করে বানিয়েছে বস্তি, দোকানপাট, গাড়ির ওয়ার্কসপ। এমনকি সরকারিভাবেও বিল-ঝিল দখল করে বহুতল ভবন গড়ে তোলার নজির রয়েছে বনানীতে। সেখানে লেকসাদৃশ্য একটি জলাভূমি ভরাট করে যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের ৯ তলা উঁচু অফিস ভবন এবং বানানো হয়েছে সারি সারি ন্যাম ফ্ল্যাট। আশপাশেই পাল্লা দিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি খালখাদ ভরাট করে গড়ে তুলেছে বহুতল ভবন, মার্কেট, আবাসিক বাড়িঘর। নার্সারির সাইনবোর্ডের আড়ালে সরকারি বহু মূল্যবান জায়গা জবরদখল করে রেখেছে আরেকটি চক্র। খোদ ঢাকা সিটি করপোরেশনও খাল-নালা ভরাট করায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ধোলাই খাল ভরাটের মাধ্যমে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেছে ডিসিসি। সূত্রাপুর খাল নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যাপক তৎপর ছিলেন। এসব কারণে খাল কিংবা বহমান পানি দেখার ভাগ্য হারিয়েছে নগরবাসী। কী এক অজানা জিঘাংসায় টিক্কাপাড়া বিলের স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে। মিরপুরে হাবুলের পুকুর, জাপানের ঝিল, বাড্ডা ও কাজীপাড়ার বিলগুলো এখন ছোট ছোট ডোবা-নর্দমায় পরিণত হয়েছে। কদমতলী, বাসাবো, নামাগোড়ান থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিলের ওপর গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ইমারত-অধিকাংশই অপরিকল্পিত, অনুমোদনও নেই রাজউকের।

বেহাল নিম্নাঞ্চল : রাজধানীর নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত 'নাগরিক সেবা'র সব কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা মহানগরীর পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল মিলিয়ে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকার ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়েছে এবং অর্ধেক এলাকায় ঢুকেছে পানি। বর্ষা-বৃষ্টি মৌসুমের তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে এসব এলাকার প্রায় ৬০ লাখ বাসিন্দা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত থাকে। নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থার বাইরেও নানা কারণে পানি জমে ওঠে। বৃষ্টি হলে পানি বেরিয়ে যাওয়ার মতো রাস্তাটুকুও পায় না। ফলে চোখের সামনেই অলিগলি, রাস্তা এমনকি নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পর্যন্ত পানি ঢুকে নানা ভোগান্তির সৃষ্টি করে।

দায়িত্ব পালনে বড়ই অনীহা : জলাভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে রাজউক ও ঢাকা সিটি করপোরেশন দায়দায়িত্ব বহন করার কথা। কিন্তু সংস্থা দুটি পরস্পরবিরোধী দোষ চাপিয়েই খালাস। সরকার নিয়ন্ত্রিত পুকুর-জলাশয় সংস্কার কিংবা পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা বরাবরই দেখিয়েছে ব্যর্থতা। রাজধানীর বিল-ঝিল, পুকুর, ডোবার ব্যবস্থাপনার জন্য রাজউক ও সিটি করপোরেশনের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। বরং দুটি সংস্থার কেউ এসবের দায়দায়িত্ব নিতে চায় না। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বলেছেন, রাজউকের সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই জলাভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে রাজউক থেকে বলা হচ্ছে, ভালো ভালো পুকুর, লেক, সচল খালগুলো সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করছে। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন জানান, অধিকাংশ জলাভূমির মালিকানা পাবলিকের। এগুলো সরকারি সম্পত্তি হলে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব নেওয়া যেত।

পরিবেশবিদরা বলেছেন, জলাভূমি ভরাট করায় পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই জলবন্দী হয়ে পড়ছে নগরবাসী। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও খাল-বিল-পুকুর ভরাট কিংবা মুক্ত প্রান্তরে স্থাপনা নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেসব ব্যাপারে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। নিষেধাজ্ঞা মানছেন না সরকারি কর্মকর্তারাও। সরকারি সংস্থা নিয়ন্ত্রিত পুকুর-জলাশয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া পড়ে না, একেকটি পুকুর-ঝিল অযত্ন-অবহেলায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্রী জঞ্জাল ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে ঢাকার দুই হাজার একশ একর জলাভূমি। কোথাও আয়েশে শ্বাস ফেলারও উপায় নেই। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, কার্যকরী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও রাজউকসহ সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ছাড়া কার্যকর ড্রেনেজ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট নিরসনে কার্যকরী উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনার অভাবও এ দুরবস্থার জন্য দায়ী।

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশমালা : এর আগে রাজধানীর পরিবেশ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা ১০ দফা সুপারিশ রাজউকে হস্তান্তর করে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মাটি ভরাটের মাধ্যমে খাল-বিল-জলাশয় নিশ্চিহ্ন করা এবং বন্যার পানি প্রবাহ নিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারিসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী জানান, রাজধানীতে জলাধার আইন' ২০০০ অমান্যকারী হাউজিং কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নগরীর বেহাত হওয়া জলাশয়ের তালিকা প্রণয়নের পাশাপাশি শীঘ্রই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে খাল-বিল উদ্ধার করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। সমীক্ষা সুপারিশের আলোকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে প্লট তৈরি কিংবা স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাজউক ইতোমধ্যে নগরীর 'ফ্লাড ফ্লো জোন' এলাকায় নয়টি হাউজিং এস্টেটের ১০টি প্রকল্পের কাজ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেছে, পানি প্রবাহ এলাকায় স্থাপনা গড়তে চাইলে রাজউক কোনো রকম নকশা ও ছাড়পত্র দেবে না। পরিবেশবাদীরা বলছেন, একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকায় কতিপয় কোম্পানি বেআইনি কর্মকাণ্ড চালানোর আস্কারা পাচ্ছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর