শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

টান টান উত্তেজনায় দেশ

*অনুমতি না দিলেও সমাবেশ নয়াপল্টনে *বাধা দিলে সারা দেশে সংঘাত
*সঙ্গে জামায়াত-শিবির *মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিরোধ করা হবে

টান টান উত্তেজনায় দেশ

২৫ অক্টোবরকে ঘিরে জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। প্রতি মুহূর্তেই উত্তাপ বাড়ছে। বাড়ছে শঙ্কা। কী হবে ২৫ অক্টোবর! রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র এখন একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষই পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডেকেছে রাজধানীতে। অনেকেই মনে করছেন, এ পরিস্থিতিতে নির্ঘাৎ নৈরাজ্যের দিকেই এগোচ্ছে দেশ। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ঈদের দিন পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ২৫ অক্টোবর সমাবেশ করার সুযোগ দিতেই হবে সরকারকে। আর দেশে কোনো একতরফা নির্বাচনও হতে দেওয়া হবে না। তবে এ অবস্থার নিরসনে সরকারকে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি পুনর্বহালের জন্য আবারও আহবান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম। এ সম্পর্কে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণদাবি উপেক্ষা করে, সরকার যদি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করে তাহলে তা হবে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দলের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।
এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতে চলছে পুলিশি তল্লাশি ও ব্যাপক ধরপাকড়। নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় বুধবার ঈদের দিন থেকেই ঘেরাও করে রেখেছে পুলিশ। কাউকে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। এত কিছুর মধ্যেও বিএনপিসহ ১৮ দলের পক্ষ থেকে ২৫ অক্টোবরের সমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে ২০ লাখ লোক জমায়েতের টার্গেট করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। মহানগর নেতারা আরও জানান, তারা আশা করছেন সরকার ২৫ অক্টোবরের সমাবেশের অনুমতি দেবে। অন্যথায় সরকারের অনুমতি ছাড়াই নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তারা সমাবেশের আয়োজন করবেন। এবার সরকারের অনুমতির জন্য কোনো অপেক্ষা করা হবে না।
বিএনপি ও ঢাকা মহানগর ১৮ দলীয় জোটের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দৃঢ় আস্থার সঙ্গে বলেছেন, ২৫ অক্টোবর থেকেই শুরু হবে বিএনপির মরণ কামড়। আমরা সমাবেশ ডেকেছি এবং সরকারের অনুমতি চেয়েছি। সভা-সমাবেশ করাটা বিএনপির সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। কাজেই ২৫ অক্টোবর যে কোনো মূল্যেই নগরবাসী এ সমাবেশ সফল করবে ইনশা আল্লাহ। আশা করি সরকার গণতান্ত্রিক এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। সমাবেশে কোনো রকমের বাধার সৃষ্টি করবে না। সরকার যদি কোনো রকমের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য সব দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। ২৫ অক্টোবর-পরবর্তী আন্দোলনকে তিনি বিএনপির অস্তিত্বের লড়াই বলেও অভিহিত করেন। অন্যদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আহূত সমাবেশ বিএনপির সমাবেশ বানচালের মাধ্যমে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ডাকা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিএনপি কার্যালয় পুলিশ দিয়ে ঘেরাও, নেতা-কর্মীদের বাড়ি তল্লাশি আর ধরপাকড় করে জনগণের আন্দোলন ঠেকানো যাবে না। এতে বরং জনরোষকে আরও উসকে দেবে সরকার।
এদিকে, ২৫ অক্টোবরের সমাবেশকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ১৮ দলীয় জোট। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে নেওয়া হচ্ছে এ সমাবেশকে। সরকার এ সমাবেশে বাধা দিতে পারে, এ কথা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রত্যাশিত যে কোনো বাধা মোকাবিলা করেই সমাবেশ সফল করার। জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজেই তদারকি করছেন ২৫ অক্টোবরের সমাবেশ প্রস্তুতির। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ আশপাশের আরও কয়েকটি জেলা থেকে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় আনার প্রস্তুতি চলছে। দল ও অঙ্গ সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে সমাবেশ ভণ্ডুলের চেষ্টা করা হলে তবে পর দিন বা ২৬ অক্টোবর থেকেই সে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ারও প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগসহ সব জেলাতেই সে প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বিশেষ করে দেশের প্রতিটি মহানগর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্তও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনে এবার গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা, জেএসডিসহ অন্য সমমনা দলগুলোর যুগপৎভাবে অংশগ্রহণের বিষয়টি নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। সমর্থন দিতে যাচ্ছে দেশের সুশীল সমাজের বৃহৎ একটি অংশ। যারা গত পাঁচ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে শুধু গ্রেফতার, হয়রানি আর তিরস্কারের শিকারই হয়েছেন। পাশাপাশি রাজধানীতে বিএনপির প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে প্রতিদিনই চলছে কর্মিসভা ও গণসংযোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঢাকঢোল না বাজিয়ে অনেকটা মৌনভাবেই নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ ও প্রস্তুতি তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠা কর্মসূচির নির্মমতার প্রতিশোধের বিষয়টি মাথায় রেখেই এ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। জামায়াতসংশ্লিষ্ট অন্য একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হলে তাদের আন্দোলন আরও গতি পাবে। এতে পর্যায়ক্রমে তারা অসহযোগের দিকেই চলে যাবে। জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা জানান, শুধু বিএনপিই নয়, তারাও এবার মরণ কামড় দিতে যাচ্ছেন। এ আন্দোলনের পর হয় তারা থাকবেন, না হয় মেয়াদোত্তীর্ণ মহাজোট সরকার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকবে। কিন্তু জীবন থাকতে জামায়াত-শিবির অবৈধভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে দেবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।
অন্যদিকে, ১৮ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের লড়াই জোটের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। এ লড়াইয়ে জেতার জন্য যা যা করার দরকার, ১৮ দল তার সব কিছুই করবে। আজ শনিবার রাত ৮টায় গুলশানের কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কাল রবিবার একই স্থানে একই সময়ে তিনি বসবেন ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে। এসব বৈঠকেই সর্বশেষ দিকনির্দেশনা দেবেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম আরও জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে সারা দেশে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন। সরকার যদি গণদাবি মেনে না নেয় তাহলে দেশ নৈরাজ্যের দিকেই যাবে। আর তাতে দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে মারাত্দকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার সব দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। তিনি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, অতীতেও কেউ একতরফা নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। আপনারাও পারবেন না। ঈদের দিন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার গোপীবাগের বাসা ছাড়াও গতকাল বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের ধানমন্ডির বাসায়ও তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। ঢাকার বাইরেও গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকালও ময়মনসিংহে বিএনপি নেতা লিটনকে আটক করা হয়েছে। তবে সব বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা আক্তারুজ্জামান বাচ্চুর নেতৃত্বে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে গতকাল শেষ হয়েছে সংগ্রাম কমিটি গঠনের কাজ। পাশের উপজেলা কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে শেষ হয়েছে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মুবিনের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠনের কাজ।

সর্বশেষ খবর